২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বসগিরি এবং সাংবাদিকদের আচরণ…

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৫:২৪ অপরাহ্ণ, ১৯ মে ২০১৮

ক্লাসনাইনে পড়াকালীন নবাগত এক বিএসসি স্যারের অনুরোধে দু’একদিন উচ্চতর গণিতের ক্লাস নিতে হয়েছিল আমাকে। বড্ড আনন্দ পেয়েছিলাম এমন ঘটনায়। সেই সঙ্গে স্যারের প্রতি পূর্ণ সম্মান আর আস্থা রেখেই ভেতরে ভেতরে আদর্শ একজন শিক্ষকের আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয় আমার মধ্যে। এক পর্যায়ে নিজেই ভালো শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করি। এক হাইস্কুলে বছরখানেক শিক্ষকতা করে সে স্বপ্ন পূরণও করি।

পড়া আর শেখার মধ্যে যে অসাধারণ এক আনন্দ আছে সেটা অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। তবে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে গিয়ে সৌন্দর্য হারানোর ভয়ে থমকে দাঁড়িয়েছি। আর শিক্ষক থাকাকালীন ছাত্রদের বকাঝঁকা, শাসন কিংবা শারিরীক নির্যাতনের বিষয় কখনও মাথাতেই আসেনি। সুন্দর আচরণ আর সুউপদেশেই শতভাগ সফল হয়েছি। তাই চাকরি জীবনে এসে বসের ‘ধমক’ কিংবা ‘বকাঝঁকা’ যেমন খেতে হয়নি, তেমনি মানতেও পারিনি কখনও। আর সাংবাদিকতা পেশায় এসে তো নয়-ই।

বলছিলাম সাংবাদিকদের আচরণ নিয়ে….। আব্বা বলতেন, ‘শিক্ষিত আর জ্ঞানীদের সঙ্গে দোজখেও থাকতে পারো, কিন্তু অশিক্ষিত আর মূর্খদের সঙ্গে কখনও বেহেস্তে নয়।’ আব্বার এ উপদেশ আমার জীবনের ফিলোসফি। তাই যখনি কাউকে অপ্রয়োজনীয় বিরূপ আচরণ করতে দেখি তখনই তাকে ‘অশিক্ষিত’ ভেবে বসি। সে সাংবাদিক কিংবা পত্রিকার মালিকই হোক। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমাদের গণমাধ্যমের অফিসগুলোতে সে ধারার ‘বসদের’ উপস্থিতি কম নয়। যদিও অধস্থনদের ধমক দেয়া কিংবা উচ্চস্বরে কথাবলার বিরূপ আচরণকে কেউ কেউ বসদের ‘দক্ষতা’ হিসেবেই দেখেন।

সীমিত অভিজ্ঞতা আমার এটা বলে যে, স্বাধীনতার পর গেল সাড়ে চারদশকে আমাদের গণমাধ্যমে ‘বসগিরির’ চরিত্রের কোনো বদল ঘটেনি। বলা যায়, নিজেদের প্রগতিশীল হিসেবে দাবি করলেও যারা পরিবর্তনকে ধারণ করতে পারেন না, আধুনিকতার সংজ্ঞা জানেন না তাদের অনেকেই ‘বস’ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তারাই গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘বসগিরি’ করছেনও। আর এসব ‘বসদের’ সুবিধা হচ্ছে, তারা স্থিতিশীল প্রজাতির। মালিক পক্ষের ‘বকাঝকা’ আর ‘ধমকাধামকি’তেও অবিচল থাকতে পারেন। অফিস ত্যাগ করেন না। আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী সেসব ‘বকাঝকা’ অধস্তনদের ওপর বিনাকারণেই ঢালতে থাকেন।

তবে এটাও সত্য, কেউ কেউ আবার বসদের ‘বিনয়’ আর ‘ভদ্রতাকে’ দুর্বলতা হিসেবেও দেখে থাকেন। এই দুই ধরনের প্রবণতাই দেখা যায়। আবার অনেক অফিসেই কোনো ‘বিগবস’ জুনিয়র কলিগদের সামনেই সিনিয়রদের (বিভাগীয় বস) চরম ধমকাধামকি আর অপমান করে থাকনে- এটা যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সে মনস্তত্ব বুঝি বোঝেন না সম্পাদক বা প্রধান সম্পাদক পর্যায়ের অনেক ‘বিগবসই’। এক্ষেত্রেও বলতে হবে এটা সেই গতানগতিক ধারার-ই বসগিরি।

কোনো দায়িত্বশীল জায়গা থেকে কেউ যদি অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েই থাকে, আর বারংবার ধমক দেয়ার মধ্য দিয়ে তা যদি সত্য হিসেবে মানতে বাধ্য করা হয়, তাহলে সেই অযোগ্যকে একই জায়গায় রেখে দিনের পর দিন বকাবকি করাও তো এক ধরনের অযোগ্যতাই। সাংবাদিকতা আর সংবাদিকতার ব্যবস্থাপনার পরিবর্তনশীলতার ক্ষেত্রে এটা বড় একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা।

আর এটাও সত্য যে, ‘নিয়ন্ত্রিত’ সাংবাদিকতা যেমন বেড়েছে তেমনি সাংবাদিকতার মূল স্রোতে পরিবর্তনও এসেছে। আধুনিক মননের শিক্ষিত তরুণরা এ পরিবর্তন ধারণ করার চেষ্টা করছেন। গতানুগতিক ‘বসগিরি’র প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেদের সরিয়ে পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে এটা বড় সমস্যা যে, পশ্চাৎপদ মানসিকতার ‘বসদের’ অযথাচিত ধমকের জবাবে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তারা? যেহেতু তারা পেশায় ইতিবাচক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে চান। ‘বসদের’ বিরূপ আচরণে ট্রমার শিকার হওয়ার পরেও তারা সেরা কাজটা কীভাবে উপহার দেবেন- এটা তাদের প্রতিনিয়তই ভাবনায় ফেলে দেয়।

একটি অনলাইন নিউজপোর্টালে কর্মরত সাংবাদিকতার এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কদিন আগে এমনি এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প শুনে আহত হয়েছি। বসের অপ্রয়োজনীয় ধমক, গালাগালি আর তার আত্মমর্যাদাবোধকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তথাকথিত সেই সাংবাদিক বস। এক পর্যায়ে কেঁদে কেটে অফিস ছাড়তে বাধ্য হয়েছে সেই নবীন সংবাদকর্মী।

তবে এটা তো গেল অনলাইন- প্রিন্টমিডিয়াতে এ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক। তবে তার পেছনে অফিসরূপ বসের অমানবিক চাপ কিংবা গোপন অপমান মূখ্য কিনা তা কিন্তু নিশ্চিত নই আমরা।

বর্তমানে আমাদের সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে সব সৃজনশীলতা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে করপোরেট ধারায়। সৃজনশীলতা এখন করপোরেট দাসও হয়ে পড়েছে। সবকিছুই এখন বাণিজ্যিক। তাই হয়তো সাংবাদিকদের আচরণও হচ্ছে বাণিজ্যিক ধারায়- এমন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা যতটা সঠিক বলে মনে করি আমি, তার চেয়ে বেশি মনে করি পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের অভিযোজিত হওয়ার ব্যর্থতাকে। পৃথিবী বদলে গেলে সব-ই বদলায়। আর সেই বদলের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে আমাদের মানবিক বদলটারও প্রয়োজন হয়। সাংবাদিকতায় বসগিরির বদলটাও সে ধারাতেই হওয়া উচিত। যিনি সে বদলে যাওয়ায় প্রারঙ্গম না হয়েও বসগিরি করছেন তাকে মূর্খ বলায় আমার কোনো কার্পণ্য নেই।

পরিশেষে এটা বিশ্বাস করতেই হবে যে, সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গি আচার-আচরণ গোটা সমাজের ওপরই প্রভাব ফেলে। আবার কোনো সাংবাদিক যখন প্রশাসন কিংবা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে অপমানিত হন, সেটা গোটা জাতিরই অপমান হিসেবে ধরা হয়। এ কারণেই সাংবাদিকদের আচরণ ভেতরে বাইরে সংযত হওয়া অবধারিত। আর এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত যে, একজন ভালো ‘বস’ পাওয়া যেকোনো সংবাদকর্মীর মানবিক অধিকার। যে অধিকারে সে নবীন সাংবাদকর্মীর পেশাজীবনটা আধুনিক ধারায় বদলে যেতে বাধ্য। আমি নিজে আজও খুঁজে মরছি স্বপ্নের সেই বসকে।

নিয়ন মতিয়ুল, লেখক ও সাংবাদিক

1 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন