১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

বাউফলে হত্যা মামলার বাদীকে হাতুড়িপেটা, ভেঙেছে হাত-পা

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ০৯:০২ অপরাহ্ণ, ১৮ জুন ২০১৮

একটি হত্যা মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ও বাদীকে অপহরণ করে হাতুড়িপেটা ও লোহার রড দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে দুই পা ও বাঁ হাত ভেঙে একটি পরিত্যক্ত ডোবার মধ্যে ফেলে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। পরে তাঁর ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও মুঠোফোনটি নিয়ে যায় অপহরণকারীরা। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ।

গত শুক্রবার রাতে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নওমালা ইউনিয়নের হোলাবুনিয়া এলাকায় ঘটে ওই নির্মম ঘটনা।

আহত ব্যক্তিকে পুলিশ উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা করান এবং অবস্থার অবনতি হওয়ায় ওই রাতেই বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

আহত ওই ব্যক্তির নাম মো. জাকির হোসেন (২৬)।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বগা ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তাঁর বাবার নাম সুনাম উদ্দিন চৌকিদার। ১৯৯৭ সালে মারা যান সুনাম উদ্দিন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে জাকির তৃতীয়। তিনি ঢাকা ল’কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বাউফল উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জাকির হোসেন বলেন, ঈদের আগের দিন শুক্রবার দিবাগত রাতে পটুয়াখালীর লোহালিয়া খেয়া পার হয়ে মোটরসাইকেলে করে বাউফলের উদ্দেশ আসছিলেন। কিন্তু তাঁর অজান্তেই দুটি মোটরসাইকেলে করে আরও ৬জন তাঁর মোটরসাইকেলের পিছু নেয়। বিষয়টি তিনি আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের বদরঘাট এলাকায় পৌঁছানোর পর বুঝতে পারেন।এরপর দ্রুত গতিতে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু একটি মোটরসাইকেল তাঁর মোটরসাইকেলকে অতিক্রম করে সামনে চলে যায়। রাত নয়টা ৫০ মিনিটের দিকে নওমালা ইউনিয়নের ভাঙা ব্রিজ এলাকায় পৌঁছালে তাঁর মোটরসাইকেলের পথরোধ করে সামনে চলে যাওয়া মোটরসাইকেলের তিনজন। তিনি (জাকির) মোটরসাইকেল থামিয়ে দৌড়ে পাশের একটি দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গেই বিষয়টি তিনি প্রথমে বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এবং বাউফল পৌরসভার মেয়রকে মুঠোফোনে জানান। মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের (অপহরণকারী) সংখ্যা বেড়ে যায়। ১২-১৫ জনের একটি সন্ত্রাসী দল দোকানের মধ্যে ঢুকে তাঁকে (জাকির) মারধর শুরু করেন।একপর্যায়ে ওই দোকান থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে টমটমে করে হোলাবুনিয়া বাজারের পশ্চিম পাশে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখেন আরও কয়েকজন। তাঁদের মধ্যে দুজন ছিলেন তিনি (জাকির) যে হত্যা মামলার বাদী সেই মামলার আসামি।

জাকির আরও বলেন, এরপর ওই দুই আসামি তাঁকে (জাকির) উদ্দেশ করে বলে আজ আর শালার রক্ষা নাই। ওকে অনেক কষ্ট দিয়ে মারতে হবে। এরপরই তাঁর ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু হয়। হাতুড়ি ও লোহার রড দিয়ে পিটাতে থাকে। একপর্যায়ে অচেতন হয়ে পড়লে মরে গেছি ভেবে ফেলে রেখে যায়।

এরপর পুলিশ গিয়ে একটি পরিত্যাক্ত ডোবার পাশ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে রাত সাড়ে ১১ টার দিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. আখতার-উজ্জামান বলেন, শরীরের বিভিন্ন অংশে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ওই রাতেই বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেটিক বিভাগের সহকারী রেজিষ্ট্রার সুদীপ হালদার বলেন, ‘তাঁর দুই পা ও বাঁম হাত ভেঙে গেছে। ফুলা কমলে অস্ত্রপচার করতে হবে।’

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে- ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রাজনগর গ্রামীণফোন টাওয়ারের সামনের সড়ক এলাকায় জাকির ও তাঁর ভগ্নিপতি মনির হোসেনের (৩৫) ওপর হামলা চালিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। আহত অবস্থায় মনিরকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ আগস্ট মারা যান মনির।

এ ঘটনায় আহত জাকির উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব হাওলাদারকে প্রধান আসামি করে ১৮ জনের বিরুদ্ধে ১২ আগস্ট পটুয়াখালীর আদালতে একটি মামলা করেন। পুলিশ ওই মামলায় প্রধান আসামিসহ ১৪ জনকে বাদ দিয়ে চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। বাদী ওই অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আপত্তি জানালে আদালত মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পটুয়াখালীর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন।

জাকির হোসেন আরও অভিযোগ করেন- বগা লঞ্চঘাট এলাকায় অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ করেন তাঁর ভগ্নিপতি হত্যা মামলার আসামি আবদুল মোতালেব ও তাঁর স্ত্রী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মোসা. রেহেনা মোতালেব। ওই ইটভাটা বন্ধ করার জন্য হাইকোটে সম্প্রতি তিনি রিট আবেদন করেন। হাইকোর্ট অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। এছাড়াও সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মোতালেবের পরকীয়া প্রেমের অডিও ফাঁস হয়েছে।যা বিভিন্ন মুঠোফোনে ছড়িয়ে পড়ছে। এজন্যও তিনি তাঁকে (জাকির) দায়ী করেন।

এসব কারণে তাঁর (জাকির) ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি (আবদুল মোতালেব)। তাই তাঁকে (জাকির) মেরে ফেলার উদ্দেশে অপহরণের পর তাঁর নির্দেশেই হাতুড়িপেটা ও লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে ডোবার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের সহায়তায় ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গেছি।

উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহামুদ রাহাত জামশেদ বলেন, ‘জাকির উপজেলা ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় সদস্য। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁর ওপর বার বার হামলা চালানো হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় আসামি করা হচ্ছে। সর্বশেষ অপহরণ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক ও ন্যাক্কারজনক।’

এসব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব হাওলাদার বলেন, ‘ঘটনার একদিন পরে শুনেছি জাকিরের ওপর হামলা হয়েছে। কে বা কারা করেছে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’

বাউফল পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘জাকির বিষয়টি তাঁকে মুঠোফোনে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওসিকে জানিয়ে তাঁকে দ্রুত উদ্ধার করার জন্য বলেন।’ পরবর্তীতে জাকিরকে ফোন করলে অপরণকারীরা ফোন রিসিভ করে। তখন জাকিরের আর্তনাদ শুনতে পাই। তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

বাউফল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ পাঠানো হয়েছে। অবস্থান পরিবর্তন করায় উদ্ধার করতে একটু দেরি হয়েছে। এরপরেও বলবো পুলিশি তৎপরতার কারণেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়া জাকিরকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

7 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন