২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শুক্রবার

মিন্টু বসুর প্রয়াণ অস্তাচলে সংগ্রাম

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, ০৪ অক্টোবর ২০১৭

অশ্বিনী কুমার দত্ত থেকে যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তা মোশারফ হোসেন নান্নু হয়ে মিন্টু বসুতে স্থিতিমিত হলো। এখন আর সমাজে অনিয়ম বা অনাচার হলে প্রতিরোধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর লোক কই, এ প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। যাও রয়েছেন ভাবেন নিজের মান বঁচানো দায় অতএব থাকি চুপচাপ। যার অর্থ দাঁড়ায় সর্বজনের আস্থায় ঘাটতি থাকা আর নিজেকে নিয়ে ভাবনা, এসব মিলে বড় দুষ্কর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হয়ে ওঠা। এই সুযোগে দেখি মেকিদের দাপট,অহরহ যাচ্ছে তাই বলে বেড়ায়, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায় আবার চোগলখুরি করে সুবিধা বাগায়।

এইসব চেয়েচিন্তে খাওয়া বেলাজ ধান্দাবাজদের কবলে মিন্টু বসুকেও পড়তে হয়েছে বহু বার বা অনেকটা অবিরাম। তাঁকে হেয় করার জন্য পাছে লেগে থেকেছে। কিন্তু ন্যায়ের পথে হাঁটায় আর সাধারণ নাগরিকদের আস্থা থাকায় মিন্টু বসু ওসব উত্রে যেতে পেরেছিলেন। শেষ দিকের দুটি বছর তাঁর অসুস্থতার সময়ে কেউবা মিন্টু বসু হয়ে ওঠার পরিকল্পনাও করেছিলেন বটে!

তাবলি কাধে ঝুলিব্যাগ নিয়ে ঘুড়লেই আর ওয়াহিদুল হক হওয়া যায়না। দ্রোহ থাকতে হয়। যতই সভামঞ্চে কথা বলে আস্থায় আসতে চান, কান পেতে ফিসফিসানি শুনলেই বুঝতে পাবেন আপনি ওসবের যোগ্য নন। সাধারণের আস্থায় ভাঁটা আছে। তেমনটা মিন্টু বসুর বেলায় হয়নি যা লক্ষ্য করেছি একসময় ইচ্ছা করে অপবাদ ছড়ানো এক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়। অকপটে স্বীকার করলেন মিন্টু বসুর সততার কথা। আর্থিক সুবিধার জন্য ধান্দাবাজি করেননি।

যার প্রমাণ মেলে শীতলাখোলা সড়কের যে ভাড়া বাসায় থাকতেন ওই মালিকের কথোপকথনে। তার উক্তি-যত বড় মানুষ ছিলেন, তাঁর আয় তত ছিল না। যার অর্থ দাঁড়ায় টাকার পেছনে ছোটেননি। নাগরিক আন্দোলন, সংগঠন, লেখালেখি এই করতে গিয়ে ওসব চিন্তার সময় পাননি। অনৈতিক কামাইয়ের কুটকৌশলী হয়ে ওঠার বিপরীতে সৃষ্টি করেছেন একান্তে আপন মনে। শোকাহত বৌদিদি কল্পনা বসুর কথায়ও অমনটাই উঠেছে এসেছে।

তিনি বললেন, মানুষটি সংসারী হননি কোনদিন। রাত আর বিরাত নেই, সংগঠন,লড়াই-সংগ্রাম এসব চিন্তা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। কোন কোন দিন শেষ রাতে ঘরে ফিরেছেন। প্রবাসী মেয়েটা কতবার বলেছে বাবা তোমার শরীর ভালো নেই, আমার কাছে থেকে যাও। কে শোন কার কথা। উত্তর ছিল ‘আমার সৃষ্টির বাংলাদেশই ভালো। ওখানে আমি জন্মেছি ওই মাটিতেই সমাহিত হতে চাই’। তাই করলেন মিন্টু বসু, সকল স্নেহ মমতা বন্ধনের উর্ধ্বে উঠে ভালো থাকা উপেক্ষা করে বরিশালেই থাকলেন। আস্থা রাখলেন তার তৈরী সাংস্কৃতিক ও সংবাদ কর্মী আর পরীক্ষিত বন্ধুদের প্রতি।

বাবা নরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন জমিদার স্টেটের নায়েব। অবস্থাসম্পন্ন পরিবার। মাতা শৈলবালা বসু। ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার বৈচন্ডি গ্রামে ১৯৪৮ সালে ১২ মার্চ মিন্টু বসুর জন্ম। তাঁর বাল্যের কথা অজানা হলেও তিনি ১৯৬৪ সালে ১৬ বছর বয়সে বরিশালে চলে আসেন। এখানের বাবুল লাইব্রেরীতে চাকুরী নেন। বয়সে অনুজ পরবর্তীতে সহযোদ্ধা আলতাফ হোসেন নামক এক সংস্কৃতি কর্মী বললেন, ১৯৬৬ সাল আজ থেকে ৫১ বছর আগের কথা।

তখন একে স্কুলে সবে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠেছেন। বিবি পুকুর পাড়ের পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখেন মিন্টু বসুর লেখা বই। লেখকের প্রাপ্তিস্থান বাবুল লাইব্রেরী যেনে সেখানে গিয়ে দেখেন এক নাগারে লিখে চলছেন অনিন্দ সুন্দর এক কিশোর হবে বৈকি। তারপরতো ১৯৬৯ সালে অনামী লেনে যুবসংঘ অফিস।

পাকিস্তানের ওই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারী পালনে নিষেধাজ্ঞার সময় বর্ণমালা দিয়ে গাছ (অক্ষর গাছ) বানায়ে অনুষ্ঠান করলেন। যুব সংঘের তরুণরাই মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে ধর্মরক্ষিণীতে বোমা তৈরী করতেন প্রতিরোধ গড়তে। ওসময় ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ নামক একটি অর্ধ সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যার অন্যতম সম্পাদক ছিলেন মিন্টু বসু এই তথ্য দিলেন কবি তপঙ্কর চক্রবর্তী।

বরিশাল আক্রমণ হলে মিন্টু বসু ভারতে চলে যান। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন বলে জানালেন মুক্তিযোদ্ধা পুতুল ঘোষ। ওখানেও রনাঙ্গনের পত্রিকা সাপ্তাহিক বিপ্লবী বাংলাদেশ প্রকাশ করেন। দেশ স্বাধীনের পর দৈনিক আজাদ, বাংলার বাণী ও সর্বশেষ একুশে টিভিতে বরিশাল প্রতিনিধি হয়ে কাজ করেছেন।

বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় একুশে টিভি’র সম্প্রচার বন্ধ করা হলে একুশে টিভি দেখতে চাই দাবী জানিয়ে মানবন্ধন করলে মিন্টু বসু সরকার সমর্থকদের হামলার শিকার হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে মামলা দিলে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিতে হয়েছিল বলে স্মৃতিচারণ করেন ওই মামলার আরেক আসামী শামীম আহমেদ। ফেইসবুকে মিন্টু বসুর প্রয়াণের খবরটা জানাতে মো.মিলন নামের একজন এখন থেকে দুই দশক আগের কথা লিখলেন। রাত তখন ১১টা।

অশ্বিনী কুমার হলের সামনে এক যুবককে সাত আটজনে মিলে মারছেন। এসময় মিন্টু বসু এগিয়ে গেলে তিনি চশমা ভেঙ্গে রক্তাক্ত যখম হন। এরপর ওই আহত যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করায়ে রাত আড়াইটায় বাসায় ফিরেন। নিজে আহত হলেও তাঁর জবাব ছিল-‘ছেলেটাকে রক্ষা করতে পেরেছি যে’। এই হলেন মিন্টু বসু।

এজন্যই নিগার সুলতানা হনুফা বললেন, মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য, পুকুর রক্ষা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বা নাগরিক সুবিধার যেকোন আন্দোলনে মিন্টু বসু না থাকলে তা বেগবান হতো না। মেকি নয়; অন্যায়ের প্রতিবাদ ছিল তাঁর স্বভাব। আর চলমান সময়ে কতিপয় সুযোগ সন্ধানীর চুপ করে থাকায় স্বাধীনতা বিরোধী আর সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ষন্ডারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সুযোগ নেয়ায় এখানেও ক্রান্তিকাল চলছে। এসময় মিন্টু বসুর চলে যাওয়া বড়ই শুণ্যতার সৃষ্টি করলো এই আক্ষেপ এসএম ইকবালের।

কম নয়; নাটক, উপন্যাস, জীবনীগ্রন্থ ও মুক্তিযুদ্ধের উপর তার ৭৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। টানা ২০ বছর খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর লেখা ৩৪ টি নাটকের মধ্যে ১৪টি প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ঢাকার নাট্য সংগঠন লোক নাট্যদল মিন্টু বসুকে দেশের শ্রেষ্ঠ নাট্যকর্মীর পদকে ভূষিত করেন।

এসব কম কিসের। তাই চেয়ে চিন্তে খাওয়া কোন কোন অর্বাচীন ফেউ হয়ে মিন্টু বসুর পিছু লেগেছিল রাশ টানতে, পারেনি। তাঁর কর্মের জোরেই স্ত্রী বেলা বসুর প্রশ্নের উত্তরে বলতেন সন্তান বিদেশ বিভূঁইয়ে অসুবিধা কি? আমার সৃষ্টি আছে না,ওরাই দেখবে। তারাই ছিলেন মিন্টু বসুর শব যাত্রায়। শোকাভিভূত হয়েছেন, নিরবে চোখের জল ফেলেছেন। এসব মিন্টু দা’র পাওনা ছিল যে।

3 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন