২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

সম্পদশালী রাখাইন সম্প্রদায় এখন নিঃস্ব

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ, ১৬ মে ২০১৮

ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রাখাইন। একসময় ছিল সম্পদশালী। চাষাবাদের ছিল জমি। হস্ত চালিত কাঠের তাঁত বুনন ছিল তাদের ঐতিহ্য। অথচ তাদের সঙ্গে সেই ঐতিহ্যও এখন বিলুপ্তের পথে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা জমিজমা দখল করায় অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এ কারণে অনেকে দেশ ত্যাগ করেছে। যারাও আছে, তারা জীবন যাপন করছে মানবেতর।

এ জনগোষ্ঠীর বসবাস পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের কানকুনিপাড়া, কাটাখালীপাড়া, ছাতিয়ানপাড়া ও মৃদুপাড়া নামের পল্লীতে। ওইসব পল্লীতে প্রায় ২২ পরিবার রয়েছে। সংখ্যায় প্রায় ৯০ জন। এদের মধ্যে পুরুষদের পেশা বর্তমানে কাকড়া-কুচে ধরা এবং মহিলাদের পেশা তাঁতের জামা-কাপড় তৈরি। এসব কাজ করেই কোনমতে তারা জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। স্থানীয় ভাষা এদের ‘মগ’ বলে। আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস। এ উপলক্ষে সরেজমিনে রাখাইন পল্লী ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

উপজেলা সদর থেকে সড়কপথে ৪ কিলোমিটার দূরে রাঙ্গাবালী ইউনিয়নের খালগোড়া খেয়াঘাট। ওখানের দারছিরা নদীর খেয়া পাড়ি দিয়ে চরগঙ্গা। ওখান থেকে সড়কপথে ৮ কিলোমিটার পথ পেড়িয়ে কানকুনিপাড়া রাখাইন পল্লী। ওই পল্লীতে ১৫টি পরিবারের বসবাস। রাঙ্গাবালীতে বসবাসরত এটাই এখন সবচেয়ে বড় রাখাইন পল্লী। পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন মাত্র ৭৫ জনে পৌঁছেছে। এখন জীবাকা চলে কৃষি কাজ এবং কাঁকড়া-কুচে শিকার করে। আর মহিলাদের পেশা তাঁত শিল্পটা টিকে আছে কোনমতে। জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে তাঁত শিল্পের চাহিদা না থাকায় এ পেশা টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। ফলে জীবিকার তাগিদ তাদের প্রতিদিন ভাবিয়ে তোলে।

ওই পল্লীতে গিয়ে কথা হয় ৮৫ বছরের বৃদ্ধ মুতাছি দেওয়া রাখাইনের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘তার প্রায় ২৪ একর জমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে দখল করে নিয়ে গেছে।  এখন কিছুই নাই ঘরের ভিটা ছাড়া। প্রভাবশালী লোকজন দখল করে নিয়েছে। জমিজমা দখল হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন সর্বশান্ত হয়ে গেছে।’ এসময় ওই পল্লীর মনোচং রাখাইন বলেন, ‘একসময় বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের প্রায় ৭ থেকে ৮শ’ একর আবাদি জমির মালিক ছিল রাখাইনরা। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেইসব জমি দখল নিয়েছে। এ কারণে অনেক রাখাইন পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখনও কিছু জমি যাদের আছে, তারাও দখল হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে বিক্রি করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়।’

রাখাইনদের অভিযোগ, স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহল চক্রান্ত করে অনেক রাখাইন পরিবারের জমি দখল করেছে। এ প্রভাবশালী মহল অন্যায়ভাবে ভূয়া কাগজপত্র তৈরী করে আবার কেউবা জবরদখল করে নিয়েছে তাদের জমি। এসব কারণে ভিটামাটি হারিয়ে ফেলছে। আর এখনও যারা টিকে আছে তারা প্রভাবশালীদের দাপটের মুখে যে কোনো সময় ভিটে ছাড়া হতে পারে এমন আশঙ্কা তাদের মধ্যে। নানা অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ছেড়ে আসা মাতৃভূমি মিয়ানমার চলে যাচ্ছে। ওই পল্লীতে ঘুরে তাত বুননের কাজ ব্যস্ত মাখেন রাখাইনের (২৪) সঙ্গে কথা হয়। তিনি কিভাবে সংসারের খরচ জোগান, এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘তাতের জামা-কাপ তৈরি করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসার। স্থানীয়ভাবে এসব জামা-কাপড়ের তেমন চাহিদা নেই। অন্যত্র বিক্রি করতে হয়।’

স্থানীয় প্রবীণ রাখাইন ও তাদের বিভিন্ন ইতিহাস খুঁজে জানা যায়, রাখাইন শব্দের অর্থ রক্ষণশীল। এদের আদিবাস মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশে। তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। ১৭৮৪ সালে বর্মরাজা আরাকান বা রাখাইন প্রে দখল করে। এ আতঙ্কে ১৫০টি রাখাইন পরিবার বাঁচার আশায় ৫০টি নৌকাযোগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে রাঙ্গাবালী দ্বীপের সন্ধান পায়। সেখানে তারা বনজঙ্গল পরিষ্কার করে ‘উত্তরীপাড়া’ নামক পল্লী করে প্রথম বসতি গড়ে তোলে এবং তাদের সঙ্গে করে আনা ধান ও ফল-মূলের বীজ বপন করে সেখানে জমি আবাদ শুরু করে। পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এরা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী কলাপাড়া, তালতলী, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন এলাকায়। তবে প্রথম বসতি গড়ে তোলা রাঙ্গাবালীর উত্তরীপাড়ায় গিয়ে রাখাইন পরিবারের অস্তিত্ব খঁজে পাওয়া যায়নি। এখন ক্রমাগত তারা বিলুপ্ত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, রাখাইনরা যখন উপকূলীয় এলাকায় বসবাস শুরু করে তখন তা ছিল অরণ্যভূমি বনজঙ্গল ও দুর্গম। তাছাড়া হিংস্র বাঘ, বন্য মহিষ, বিষধর সাপ ডাঙ্গায় আর জলে ছিল কুমিরের বিচরণ ভূমি। তবুও তারা বহু কষ্টে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গায় গাছপালা ও ঝোপঝাড় কেটে ঘরবাড়ি ও আবাদিজমি তৈরি করে। হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্য উঁচু মাচা তৈরি করে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করত।

6 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন