বরিশালে যুবতীর প্রেম-বিয়ের ফাঁদে নিঃস্ব যুবকরা দিশেহারা

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল >> যুবকদের প্রেমের জালে ফেলে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ছবি-ভিডিও চিত্র ধারণের পর ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে। এরপর মামলা ও নানা ভয় দেখিয়ে মোটা মোহরানা আদায়ের ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিয়ে যুবকদের নি:স্ব করছেন বরিশালের এক যুবতী। বিয়ের পর প্রতারণার মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়াই তার মূল উদ্দেশ্য। জেলার উজিরপুর উপজেলার ওটরা ইউপির চকমান গ্রামের সাথী নামের এ যুবতীর ফাঁদে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন একাধিক যুবক ও তাদের পরিবার। ধুরন্ধর সাথীর বিরুদ্ধে বিয়ের নামে অনেক যুবককে ফাঁদে ফেলে অর্থ-সম্পদ লুট, প্রতারণা-জালিয়াতি ও নিরীহ লোকদের মামলায় ফেলে হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি সাথী নামের ওই যুবতীর প্রতারণা-জালিয়াতিসহ অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তথ্য দিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী যুবক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। তাদের দাবি সাথীর সকল অপকর্মের সাথে জড়িত রয়েছেন তার নিকটাত্মীয় মো. কাওসার ও ফারুক হোসেন। অভিযোগ রয়েছে খোদ সাথীর বাবা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে আলমগীর মাষ্টারের বিরুদ্ধে। যিনি বিয়ের নামে মেয়ের একের পর এক অপকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে একাধিক যুবকের নিকট থেকে মোটা মোহরানা আদায়ে সহযোগীতা করেছেন।

একাধিক ভুক্তভোগী জানান, বরিশাল নগরীতে ভাড়া বাসা নিয়ে একা বসবাসকারী জেলার উজিরপুর উপজেলার চকমান গ্রামের যুবতী সাথী বিয়ে করেছেন বেশ কয়েকটি। বিয়ে করে কিছুদিন পর সেই স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া এবং তার কাছ থেকে দেন মোহরসহ নানা কৌশলে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই তার ব্যবসা। সাথীর মূল টার্গেট সম্পদশালী ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবী পুরুষ। এরপর প্রতারণার জালে ফাঁসানো ব্যক্তির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে সংসার না করে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর নির্যাতন, অত্যাচার, মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

সাথীর প্রতারণা ফাঁদে আটকে হয়রানির শিকার আল-আমিন হাওলাদার নামের এক ভ‚ক্তভোগী যুবক জানান, তিনি বরিশাল নগরীর ২৩ নং ওয়ার্ডের নবগ্রাম রোডের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার আব্দুর রব হাওলাদারের ছেলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বরিশাল শাখায় তিনি সরকারি একজন নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে চাকুরী করছেন। প্রতারক সাথী একই ব্যাংকে অস্থায়ীভাবে কর্মরত থাকার ফলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তার সাথে আমার পরিচয় হয়। তখনই সাথী আমাকে টার্গেট করে এবং পরবর্তীতে কোনো উপায়ে আমার ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে। পরে একাধিকবার মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে সাথী তার নিজের পরিচয় গোপন করে আমার সাথে কথা বলা শুরু করেন। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে নিজ দেহের সৌন্দর্য ও কথা মালার মারপ্যাঁচে আমাকে আটকে ফেলে নিজের সঠিক পরিচয় দেন। এর কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন সাথী তার মা-বাবার সাথে দেখা করানোর ছলে আমাকে বরিশাল নগরীর বি.এম কলেজ সংলগ্ন তার ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। আর সেখানে যাওয়ার পরেই আমি প্রতারক সাথীর আসল চেহারা দেখতে পাই। সাথী নিজের সাথে আমাকে বাসা নেয়ার পরে ডাক-চিৎকার দিয়ে লোকজন ডাকার ভয় দেখিয়ে অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ছবি-ভিডিও চিত্র ধারণ করে। এরপর সাথী বিয়ের জন্য আমাকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে এবং একাধিকবার তার নিকটাত্মীয় কাওসার ও ফারুকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের হুমকি দেয়। একপর্যায়ে কাওসার ও ফারুকের সহযোগীতায় ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আমাকে নগরীর বগুড়া রোডস্থ কাজী অফিসে নিয়ে সাথী প্রতারণার মাধ্যমে নিজেকে ‘কুমারী’ দাবি করে চার লাখ টাকার মোহরানায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন এসব ঘটনা আমি আমার পরিবারকে না জানানোর ফলে সাথী তার ভাড়া বাসায়ই থাকতেন। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই মোহরানার চার লাখ টাকা দাবি করে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য সাথী আমাকে চাপ দেওয়া শুরু করে।

আল-আমিন আরও জানান, বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য চাপ প্রয়োগের পরে প্রতারক সাথী তার বিরুদ্ধে বরিশাল মেট্রোপলিটন কোতয়ালী মডেল থানায় একটি মিথ্যা অভিযোগ দেন। তখন আমিও প্রতারক সাথীর অর্থ হাতানোর কৌশল নিশ্চিত হয়ে সকল ঘটনা উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে কোতয়ালী মডেল থানায় অভিযোগ দেই। উভয় অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসআই রুমা বেগম একাধিকবার আমিসহ আমার পরিবারকে থানায় ডেকে নিয়ে সালিশ মিমাংসার জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রতারক সাথী অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দায় থানা পুলিশের সালিশ-মিমাংসার বৈঠকে বসতে অপরাগত প্রকাশ করেন। এর কয়েকদিন পরে একইভাবে বিএমপি পুলিশের একজন উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে অভিযোগ দিয়ে ফের হয়রানি করেন।

তিনি আরও জানান, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সাথীর হয়রানি থেকে রক্ষার্থে ও চাকুরি বাঁচাতে মোহরানার চার লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করলে ২০২১ সালের ৯ নভেম্বর নগরীর স্ব-রোডস্থ কাজী অফিসে বসে সাথী আমাকে তালাক দেয়। তবে, শর্ত থাকে এক সপ্তাহের মধ্যে তালাকনামায় সাথী তার পক্ষের স্বজনদের স্বাক্ষর করিয়ে মোহরানার বাকি ৫০ হাজার টাকা নিবেন। কিন্তু শর্ত মোতাবেক সাথী তার পক্ষের সাক্ষীদের দিয়ে ওই তালাকনামায় স্বাক্ষর করাননি। উল্টো আমার কাছ থেকে ফের অর্থ আদায় করতে গত বছরের ১ ডিসেম্বর বরিশাল জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে একটি মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে মিমাংসার জন্য ৬ ডিসেম্বর আমাকে সেখানে উপস্থিত হতে নোটিশ করা হয়। নির্ধারিত তারিখে লিগ্যাল এইড অফিসে উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্টদের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে তারা সাথীকে পূর্বের শতানুযায়ী মিমাংসার জন্য বলেন। কিন্তু অর্থলোভী সাথী এতে ক্ষান্ত না হয়ে অর্থ আদায়ের জন্য সম্প্রতি আবারও বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতর ও মানবধিকার কমিশনে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমি এবং আমার পরিবারকে হয়রানি শুরু করেছে।

প্রতারক যুবতী সাথীর হয়রানি থেকে বাঁচতে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগীতা কামনা করে ভ‚ক্তভোগী আল-আমিনের বাবা আব্দুর রব হাওলাদার বলেন, সাথীর বিরুদ্ধে এখনই কঠোর আইনি পদক্ষেপ না নিলে তিনি এভাবে একের পর এক যুবককে ফাঁদে ফেলে তাদের অর্থ-সম্পদ লুটে নেবে। অবিলম্বে সাথী ও তার সহযোগীদের সব অপকর্ম বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবিতে তিনি বিজ্ঞ আদালতের সহযোগীতা চেয়ে আবেদন করবেন বলেও জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধূর্ত প্রকৃতির সাথী মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রতারণা মাধ্যমে ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট নোয়াখালী জেলাধীন শ্রীপুর সাকিনস্থ জনৈক সাহাব উদ্দিন আজাদের পুত্র মোঃ শরিফ উদ্দিনের সাথে প্রথম বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৬ জুলাই সেই স্বামীর ঘর থেকে নগদ ৯০ হাজার টাকা ও ৩ ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে বেরিয়ে যায় সাথী। তার উশৃঙ্খল জীবনযাপন ও মালপত্র চুরির ঘটনায় শরিফ উদ্দিন তার আইনজীবীর মাধ্যমে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর ডাকযোগে একটি লিগ্যাল নোটিশও পাঠিয়েছিলেন। পরে ওই বছরের ২০ অক্টোবর শরিফ উদ্দিন তাকে তালাক দেন। পরবর্তীতে তার কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে ২০১৯ সালে সাথী নিজে আত্মগোপনে থেকে অপহরনের নাটক সাজিয়ে নোয়াখালী জেলা ডিবি পুলিশের মাধ্যমে শরিফ উদ্দিনকে হয়রানি করেছিলেন।

সাজানো অপহরনের ঘটনায় শরিফ উদ্দিনকে ফাঁসাতে নোয়াখালী সুধারাম থানার বাসিন্দা রুবেল নামে এক যুবককে দিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সাথী নিজের অপহরনের অভিযোগ করান। কিন্তু প্রতারক সাথীর অপহরনের সেই মিথ্যা নাটক তৎকালীন নোয়াখালী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যদের কাছে ধোপে টেকেনি। তদন্তে নেমে তথ্য-প্রযুক্তির সহযোগীতায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারী অভিযোগকারী রুবেলের বাসায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক সাথীকে আটক করেন। ওই ঘটনায় নোয়াখালী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. আকতার হোসেন জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। যাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, আমার সার্বিক অনুসন্ধানকালে ও ভিকটিমকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, বিবাদী মো. শরীফ উদ্দিন এর ক্ষতিসাধন ও হয়রানি কল্পে ভিকটিম সাথী (২০) পরিকল্পিতভাবে নিজেই আত্মগোপন থাকিয়া উক্ত ঘটনার সৃষ্টি করে।

সূত্রে জানা গেছে, নোয়াখালীর ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে বছর ঘুরতেই সাথী বরিশালে চলে আসে। এরপরই প্রেমের জালে ফেলে ব্ল্যাকমেইল এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বরিশাল নগরীর আল-আমিনকে বিয়ে করেন।

এদিকে বিয়ে নিয়ে প্রতারণাসহ এসব কর্মকান্ডের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত সাথী ও তার সহযোগীদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি। এমনকি তাদের মোবাইল ফোনে কল করে যোগাযোগ করা হলে সংবাদকর্মীর পরিচয় পাওয়া মাত্র সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

বিয়ে নিয়ে এসব অপকর্মের বিষয়ে বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির কয়েকজন প্রবীণ আইনজীবীর সাথে কথা বললে তারা আমার সংবাদকে জানান, যদি কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয় বা পরবর্তী বিয়ে করার সময় প্রথম বা আগের বিয়ের তথ্য গোপন রাখেন, তা যদি দ্বিতীয় বিবাহিত ব্যক্তি জানতে পারেন, তাহলে ৪৯৫ ধারা অনুযায়ী অপরাধী ১০ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবেন। এছাড়া ৪৯৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আইনসম্মত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত প্রতারণামূলকভাবে বিয়ে সম্পন্ন করেন, তাহলে অপরাধী ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।