প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সারা দেশে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগের অংশ হিসেবে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলাজুড়ে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। আর এক শ্রেণির দালালচক্র এ প্রকল্পকে পুঁজি করে চালাচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ বাণিজ্য। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র।

পল্লী বিদ্যুতের ঠিকাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং অফিসের কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে এ দালালচক্র বিদ্যুতের খুঁটি, লাইন স্থাপন এবং মিটার সংযোগ নিশ্চিত করার অজুহাতে আগ্রহী গ্রাহকদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা আদায় করছে। গ্রাহকদের অভিযোগ- ঘুষছাড়া বিদ্যুৎ লাইন কিংবা সংযোগ কিছুই মিলছে না।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী-লাইনম্যান ও ঠিকাদার মিলে বিদ্যুৎ সংযোগের নামে মিটার, তার ও খুঁটি বাণিজ্য করে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।

নাজিরপুর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ১০১৯ কিলোমিটার বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণের কাজ চলছে। বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি এসব কাজ বাস্তবায়ন করছে। যার মধ্যে ৫৪৩ কিলোমিটার লাইন স্থাপন করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৪৭৬ কিলোমিটার লাইন স্থাপনের কাজ চলমান।

গ্রাহকদের অভিযোগ- খুঁটি, লাইন এবং মিটারের জন্য গ্রাহকগ্রতি ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা করে চাঁদা ধরা হয়েছে। গ্রামে গ্রামে নির্ধারিত দালালদের মাধ্যমে এসব টাকা আদায় করা হচ্ছে। কোনো কারণে দালালদের দাবি করা টাকা দিতে অস্বীকার করলে কিংবা প্রতিবাদ করলে নানা অজুহাতে ওই গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগের বাইরে রাখা হচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে এবং ঠিকাদারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই ইলেকটিশিয়ান নামক দালালচক্র এসব অপকর্ম করছে। যার সুবাদে পল্লী বিদ্যুতের নাজিরপুর সাব জোনাল অফিসটি দালালচক্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

পল্লী বিদ্যুৎ আফিস সূত্রে জানা যায়, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নতুন লাইনের ক্ষেত্রে মিটার বাবদ জামানত ফি ৪০০ টাকা, সদস্য ফি ৫০ টাকা, আবেদন জমা বাবদ ১০০ টাকা, সর্বমোট ৭৫০ টাকা। এ ছাড়াও পুরনো লাইনের ক্ষেত্রে অনলাইনের আবেদন ফি ১০০ টাকা বাড়তিসহ মোট ৮৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নাজিরপুর উপজেলার উত্তর শাখারীকাঠী গ্রামের পরিমল দাশ (৪০) জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে তাদের গ্রামে নতুন বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণের জন্য টেন্ডার হয়। যাহার প্যাকেজ নম্বর Lot No-PRJ-N/E- DNE-17328। কিন্তু ৪/৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরেও কাজ শুরু না হলে তারা কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থা কাওসার খানের সাথে যোগাযোগ করেন। এ সময় কাওসার খান তাদের ৮০টি গ্রাহকের কাছে ৮০ হাজার টাকা দাবি করেন। ওই টাকা পেলেই তারা খুঁটির কাজ শুরু করবেন বলে জানান। তখন তাদেরকে ৩০ হাজার টাকা দেওয়া হলে ২০১৮ সালের জুন মাসে ওই সংস্থা খুঁটির কাজ শেষ করে বাকি কাজ ফেলে রাখে। পরবর্তীতে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে বাকি টাকা পরিশোধ করলে কাজ শুরু হবে বলে জানানো হয়। এ ঘটনায় নাজিরপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

নাজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মুনিরুল ইসলাম মুনির লিখিত অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বিষয়টি তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একই অভিযোগ করেন উপজেলার কলারদোয়ানিয়া ইউনিয়নের কোকরাকাঠী এলাকার গ্রাহক সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রায় একবছর আগে তাদের এলাকায় লাইন সম্প্রসারণের জন্য প্যাকেজ নম্বর ৫৮০/১ এর টেন্ডার হয়। কাওসার খান নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই প্যাকেজ বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছেন। কিন্তু সেখানেও কাজ শুরু হয়নি। তার যোগাযোগ করলে গ্রাহকপ্রতি খরব বাবদ ৫০ হজার টাকা দাবি করলে তাকে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। ওই টাকা দেওয়ার পরে ৮টি খুঁটি নিয়ে ওই এলাকায় ফেলে রাখে। এখনও কাজ শুরু না করে আরো টাকার জন্য নানা টালবাহানায় কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।

উপজেলার বুইচাকাঠী এলাকার প্রাহক আউয়াল বলেন, একটি আবাসিক সংযোগের জন্য আবেদন করে দুই বছর যাবৎ অপেক্ষায় আছি, কিন্তু সংযোগ পাচ্ছি না। এখানে নিয়ম অনুযায়ী কোনো কাজ হয় না। দালালদের কাছে গেলে সহজে সমস্যার সমাধান হয়।

কাওসার খান নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি লুত্ফর রহমান উত্তর শাখারীকাঠী এলাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা গ্রহণের কথা স্বীকার করে জানান, মালামাল পরিবহনের খরচ বাবদ গ্রাহকদের কাছ থেকে এ টাকা নেওয়া হয়েছে। কার্যাদেশ পাওয়ার পরে কাজ বাস্তবায়নের সকল খরচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বহন করা কথা থাকলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে কেন টাকা নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি মোবাইলের লাইন কেটে ফোন বন্ধ করে রাখেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পিরোজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতাধীন নাজিরপুর জোনাল অফিসের এজিএম সুমন সাহা বলেন, আমরা এ বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতন করার লক্ষ্যে এলাকায় মাইকিং করিয়েছি। বিদ্যুতের নাম করে কেউ টাকা চাইলে তাকে ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। তার পরেও গ্রাহকরা টাকা দিলে আমাদের কি করার আছে।