নিজস্ব বার্তা পরিবেশক:: বরিশালের সংসদীয় আসন-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা)-এ পঙ্কজ দেবনাথই সব। তার কথায়ই সব হয়। তার সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কারও শক্তি নেই। তিনি ইচ্ছে হলেই আওয়ামী লীগকে জেতান, আবার ইচ্ছে হলে ডোবান। এ কারণে দুই উপজেলা ও ছয়টি ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাদের। এই এমপির প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য রয়েছে নিজস্ব দাদা বাহিনী। আর এই দাদা বাহিনী সদস্যরা হচ্ছেন সাবেক জাতীয় পার্টি, জামায়াত, বিএনপি ও বিভিন্ন দল থেকে আসা লোকজন। তার রয়েছে দখল বাহিনীও। এই দখল বাহিনীর নেতৃত্ব দেন তারই চাচাতো ভাই রিপন দেবনাথ ও রামনাথ দেবনাথ। এ ছাড়াও হিজলার গৌরবদী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মিলন, সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যানের ছেলে তারেক ও তিন ইউপি মেম্বারকে দিয়ে তিনি চর দখল ও চাঁদা তোলার কাজ করে থাকেন। তার হুকুম বাস্তবায়নে কাজ করেন হিজলার রিপন মাস্টার ও মিলন চেয়ারম্যান। অন্যদিকে দুই চাচাতো ভাইকে দিয়েই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

শুধু তাই নয়, এলাকায় তার সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ যেতে পারে না। এই এমপির কথাতেই হাট ডাক, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি গঠন হয়। সরকারি জলমহাল ও বালু মহালের দখলদার ও নিয়ন্ত্রকও তিনি। তার লোকজনই দুই উপজেলার দুই শতাধিক নৌঘাটের নিয়ন্ত্রক, তারাই চাঁদা তোলেন এবং সেই টাকা এমপির পকেট ভরেন। নৌঘাট দখল, প্রতিটি খাদ্যগুদামে চাঁদাবাজি এবং কয়েকটি চরের কয়েক হাজার জমি ইচ্ছেমতো ইজারা দিয়ে চাঁদার তোলার অভিযোগ রয়েছে এ সংসদ সদস্যর বিরুদ্ধে। এমনকি তিনি তার দুই উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনোভাবেই পাত্তা দেন না বলে ও জানা গেছে। এসব তথ্য তার আসনের দুই উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলার আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের বিভিন্ন নেতা ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

নানা অভিযোগ পঙ্কজের বিরুদ্ধে : পঙ্কজ দেবনাথ স্বেচ্ছাসেবক লীগের নামে ঢাকা ও তার গ্রামের বাড়িতে নিজস্ব সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী গঠন করেছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন খেয়াঘাট, টেম্পো স্ট্যান্ড, জলাশয়, লঞ্চঘাট, হাটবাজার, নদীর বালু, মাছের পাড়া, খাদ্য গোডাউন, ভ‚মি অফিস, ইটভাঁটা থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলেছেন। তিনি সরকারি খাস জমি বরাদ্দের নামেও বাণিজ্য করেছেন। দখল বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তার বিরুদ্ধে গত বছর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্যও জানানো হয়। তবে সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের অসাংগঠনিক কার্যক্রম, দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ও লুটপাটের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।

সংখ্যালঘুরাও তার কাছে নিরাপদ নয় : বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের কাছে ওই এলাকাল সংখ্যালঘুরা নিরাপদ নয়। কয়েক বছর আগে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় শীল হাত-পা বেঁধে তার লোকজন পঙ্গু বানিয়ে দেয়। সেই পঙ্গু সঞ্জয় অবশেষে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন বলে জানা গেছে। পরবর্তী সময়ে এ সঞ্জয় শীল অবশেষে আদালতে মামলা করলেও এলাকায় আসতে পারেননি। প্রাণের ভয়ে এখন সঞ্জয় বরিশালে আত্মগোপন করে জীবনযাপন করছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও দুই বছর আগে মেহেন্দীগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগের শাহীন ইকবালকে ধরে নিয়ে তার লোকজন হাত-পা ভেঙে দেয়। বাধ্য হয়ে তিনিও এলাকা ছাড়া হয়েছেন।

ভুয়া রাম খতিয়ান খুলে সরকারি জমি দখলের চেষ্টা : পঙ্কজ দেবনাথ তার চাচাতো ভাই রামকৃষ্ণ দেবনাথে নামে রাম খতিয়ান খুলে সরকারি দেড় হাজার জমি দখলের চেষ্টাও করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এটি করা হয়েছিল আলীমাবাদ ও শ্রীপুর চরে। এমপির এই অপকর্ম ধরা পড়ে যায় সাবেক বরিশাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামানের কাছে। পরে সেই খতিয়ানের বিষয়টি আর বালাম বইয়ে তোলা হয়নি বলে জানা গেছে।

সরকারি খাদ্য গোডাউনগুলো জিম্মি : তার উপজেলার যে কটি সরকারি খাদ্য গোডাউন রয়েছে সেগুলো থেকেও তিনি চাঁদাবাজি করেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবছর প্রতিটি খাদ্য গোডাউন থেকে তাকে দেড় কোটি টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলেই ওই গোডাউনের কর্মকর্তাদের তিনি নানাভাবে হুমকিধমকি দেন। এমনকি ধান ও গম কেনা কার্যক্রমে তার লোকজন দিয়ে বাধাও দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জল, বালুমহাল ও ঘাটগুলো দখলের পর নিয়ন্ত্রণ : পঙ্কজ দেবনাথ তার সংসদীয় আসনের সব কটি জল ও বালুমহাল দখল করে ইচ্ছেমতো ইজারা দিয়েছেন। এসব জলমহালের ইজারা তার লোকজন ছাড়া কেউই পায় না। কেউ চেষ্টা করলেও তাকে দেওয়া হয় না সেই ইজারা। আর এসব জলমহালের নিয়ন্ত্রক তারই চাচাতো ভাই রিপন দেবনাথ। তার মাধ্যমেই তিনি জলমহাল ও বালুমহাল কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এসব বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেই তার বাহিনী দিয়ে তাকে ইচ্ছেমতো পেটান ও হুমকি দেন।

চিংড়ি ধরলে তার লোকজনের কাছে বিক্রি করতে হবে : হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে কোনো নদীতে চিংড়ি ধরলেই তা তার লোকজনের কাছে বিক্রি করতে হবে বলে এমপির অঘোষিত ঘোষণা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তারা আরও জানিয়েছেন, কোনো জেলে চিংড়ি ধরলেই তার লোকজনের কাছে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। পরে তারা সেই চিংড়ি ৭০০ টাকায় বিক্রি করে। এ ছাড়াও এমপি তার লোকজনকে দিয়ে বিভিন্ন নদীতে রেণু পোনা ও মা ইলিশ ধরান।

দলীয় কর্মীকে হত্যার অভিযোগ : ভাসানচরের ইউপি নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করায় সমীর চারু নামে একজন আওয়ামী লীগের কর্মীকে খুন করা হয়েছিল। অন্যদিকে জয়নগর ইউনিয়নে নৌকায় ভোট দেওয়ার কারণে চার সন্তানের জননী সান্ত¡না বেগমকে ব্যাপক মারধর করা হয়। সান্ত¡না চার দিন একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মারা যান।

চরের জমি ইজারায় প্রতিবছর আয় ৪০০ কোটি : এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে গোবিন্দপুর শ্রীপুর ও চর গৌরবদী ইউনিয়নে নতুন জেগে ওঠা ৪০ হাজার একর চর মহিষ পালন ও স্থানীয় জেলের নামে ইজারা দিয়েছেন নামমাত্র মূল্যে। প্রতিবছর এই প্রতি একর জমি থেকে তার নিয়োগকৃত তিন মেম্বার ১০ হাজার করে টাকা তোলেন। যা বছরে হিসাব করলে দাঁড়ায় ৪০০ কোটি টাকা। তিনি এ ইজারা থেকে গত ৬ বছরে আয় করেছেন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। তিন ইউনিয়নের চরগুলোয় তার নিয়োগকৃত মেম্বার সামছু, জয়নাল ও কৃষ্ণা এ ইজারার টাকা প্রতিবছর তোলেন। এরপর সেই টাকা চলে যায় পঙ্কজ দেবনাথের ব্যাংক হিসেবে। পঙ্কজ দেবনাথ তার আপন চাচাতো ভাই মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি রামনাথ দেবনাথের মাধ্যমে আলিমাবাদ ও শ্রীপুর চরের দেড় হাজার একর খাস জমি ভুয়া খতিয়ানভুক্ত করেছেন। এ ছাড়াও বিদ্যানন্দপুর ইউনিয়নে শাহ আলমের ইটভাঁটা তার লোকজনকে দিয়ে জোরপূর্বক দখল করেন। এই ইটভাঁটার একটি টাকাও সেই শাহ আলম পাননি বলে জানা গেছে।

একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও নিয়োগ বাণিজ্য : নিয়ম হচ্ছে একজন সংসদ সদস্য তার এলাকার সর্বোচ্চ চারটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি হতে পারবেন। কিন্তু পঙ্কজ দেবনাথ একাধারে দুই উপজেলার আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো পাতারহাট সিনিয়র মাদ্রাসা, উলানিয়া মোজাফফর খান ডিগ্রি কলেজ, পাতারহাট মহিলা কলেজ, দেশরত্ন শেখ হাসিনা কলেজ, কাজীরহাট একতা কলেজ, বিদ্যানন্দপুর ভাসানচর কলেজ, মাউনতলা সিনিয়র মাদ্রাসা, হিজলা ডিগ্রি কলেজ (এখন সরকারি) ও উলানিয়া ডিগ্রি কলেজ।

ভারতে বাড়ি ও কানাডায় সেকেন্ড হোম : পঙ্কজ দেবনাথের একসময় একটি টিনের চালার ঘর ছিল। কিন্তু এখন সব বদলে গেছে। ঢাকার উত্তরায় তিনি এমপি হওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে দশ তলা একটি বাড়ি করেছেন। এ ছাড়াও তার এলাকায় দুই উপজেলায় দুটি প্রাইভেটকার রয়েছে, বিভিন্ন চরে তার পরিবারের হাজার বিঘা জমি, ধানমন্ডিতে বিলাসবহুল বাড়ি, অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও গার্মেন্টস এবং পরিবহন রয়েছে। ভারতের সল্টলেকে তার নিজস্ব একাধিক বাড়ি ও মার্কেট রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি কানাডায় সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। সেখানে স্থায়ীভাবে থাকারও আবেদন করেছেন। রাশিয়ার মস্কোতে তার বোন জামাইয়ের মাধ্যমে সেখানে ডেভেলপার ব্যবসায় পুঁজিও বিনিয়োগ করেছেন এই নেতা। মেহেন্দীগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা আনোয়ার হোসেন সাগর বলেন, পঙ্কজ দেবনাথ ১/১১-এর সময় শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে গ্রেফতার হন। তার বিতর্কিত নানা কর্মকান্ডের কারণে সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথকে সম্মেলনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে পঙ্কজ দেবনাথের মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কল করা হলেও ফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।