২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

ক্রিকেট, বেড়াল আর গানের ঘর

বরিশাল টাইমস রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:৫৫ অপরাহ্ণ, ২০ মার্চ ২০১৬

ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটার হওয়ার। টেবিল টেনিসের পুরস্কার সাজানো বসার ঘরে। রবীন্দ্রনাথের গানে তিনি আশ্রয় খোঁজেন। ভালবাসেন জন লেনন। পোষ্য থেকে ঈশ্বর— এবেলার সঙ্গে চা-এ স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত।

 

শান্তা রঙ্গস্বামী, ডায়না এডুলজি, কেয়া রায়, শ্রীরূপা বসু…।

হঠাৎ করে এসব নাম শুনলে কিছু মনে পড়ে কি?

কারও কারও নিশ্চয়ই পড়ে। কিন্তু হলফ করে বলা যায়, অধিকাংশ ভারতীয় এই নামগুলির সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নন।

পরিচিত ছিলেন না সাংবাদিক। আশি-নব্বই দশকের ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের কথা কেনই-বা মনে থাকবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এখনও কতটা পাত্তা দেয় মহিলা ক্রিকেটারদের? ‘এবেলার সঙ্গে চা’য়ের আড্ডায় আক্ষেপ করেছিলেন ঝুলন গোস্বামী।

পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়া ডিঙোতে পেরেছিলেন তিনি। মেয়েকে নিয়ে ইডেন গার্ডেন্সে নিয়মিত ভারতীয় মহিলা দলের খেলা দেখতে যেতেন বাবা। কমলা লেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন গেঁথে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়ের স্বপ্নে। ক্রিকেট নিয়ে অনর্গল কথা চালিয়ে যেতে পারেন তিনি। সাল ধরে ধরে মুখস্থ বলে যেতে পারেন মহিলা ক্রিকেটারদের নাম।

বিধাননগর কলেজের উল্টো দিকে সল্টলেকের পরিচিত আবাসনে অপ্রশস্ত ফ্ল্যাট। অপ্রশস্ত বলা যায় কি? জিনিসে ঠাসা দেশলাই-ঘরের আয়তন বোঝা প্রায় অসম্ভব। প্রথম দর্শনে মনে হয়, কোনও বুটিকের স্টোররুম। একঘর জিনিসের মাঝখানে লুকোচুরি খেলছে গুজরাতি সোফা। চেয়ারের উপরেও জিনিস। তবে বসার সময় সেগুলো সরিয়ে রাখার মতো ফাঁকা জায়গা

আছে। টইটম্বুর ঘর কিন্তু অগোছালো নয়। স্তূপের ভিতর কোথায় কোন জিনিস, তাঁর মুখস্থ।

‘‘এসব কিছুই ফেলতে পারি না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পাওয়া উপহার। ভালবাসার ধন। ফেলা যায়?’’

মলঝলমল করতে করতে ঘরে ঢুকলেন স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত। ‘এবেলার সঙ্গে চা’য়ের অতিথি। ডানদিকের চেয়ারে রাখা বেড়ালের ছবি সরিয়ে বসার জায়গা করে নিলেন।

ভারী মজার সব ছবি। সাদা-কালো বেড়ালের উজ্জ্বল ‘ক্যাট আই’ থেকে প্রেম ঝরে পড়ছে। শিল্পীকে জড়িয়ে ধরে ক্যামেরার সামনে ‘পোজ’ দিয়েছে সে। মাত্র কয়েকদিন আগে আবাসনেই পোষ্যের ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন তিনি। যদিও স্বাগতালক্ষ্মী বলছেন, তিনি ফোটোগ্রাফার নন। ভাল ক্যামেরাও তাঁর নেই। মোবাইলেই তুলেছেন সমস্ত ছবি। বন্ধুদের অনুরোধে প্রদর্শনী করেছেন। মজা করেছেন ছবির ‘ক্যাপশন’ নিয়ে।

ছোট্ট মিউকে ঘরে নিয়ে এলেন গায়িকা। তার শরীর ভাল নেই। বছরখানেক আগে কার্পেটের তলা থেকে প্রায় দমবন্ধ অবস্থায় ওকে উদ্ধার করেছিলেন শিল্পী। তারপর থেকে বেড়ালছানা গায়িকার সঙ্গী।

অনর্গল কথা চলছে। কিন্তু গানের গপ্পো কই? বসন্তের পলাশ থেকে অধ্যাত্মবাদ— চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’, বেড়ালের ‘শ’, রুমালের ‘মা’— আড্ডা চলছে লাগামছাড়া। শুধু গান নেই।

কলেজের প্রথমবর্ষে ক্রিকেট খেলা বন্ধ হল শিল্পীর। পাড়ার ম্যাচে ফার্স্ট স্লিপে ফিল্ডিং করছিলেন। ব্যাটসম্যানের ব্যাটের ‘এজ’ ছুঁয়ে বল এসে লাগল চোখে। ক্রিকেটের স্বপ্ন ভন্ডুল হল। মা বলে দিলেন, হয় খেলা ছাড়তে হবে, নইলে মা’কে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়ের চিন্তা অনাবশ্যক নয়। বিয়ে দিতে হবে তো মেয়ের !

গানে ঢুকল আড্ডা। স্বাগতালক্ষ্মীর বাবা উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের খুব বড় শিল্পী ছিলেন। অনেকেই তা জানেন। বহু প্রতিষ্ঠিত শিল্পী তাঁর কাছে তালিম নিতেন। কিন্তু স্বাগতালক্ষ্মীর মা-ও যে খুব বড় গাইয়ে ছিলেন, অনেকেই তা জানেন না। জর্জ (দেবব্রত) বিশ্বাসের স্নেহধন্য ছাত্রী। কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের অধিকাংশ মেয়ের ক্ষেত্রে যা হয়, তাঁর জীবনেও ঠিক সেটাই ঘটেছিল। বিয়ের পর গান কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্বাগতালক্ষ্মী বলছেন, পরবর্তীকালে তিনি বুঝেছেন, মায়ের একটা অভিমান ছিল। বাড়িতেও কখনও সকলের সামনে গান গাইতেন না। রান্না করতে করতে মায়ের গুনগুন এখনও তাঁর কানে ভাসে।

স্বাগতালক্ষ্মীর গান নিয়ে কখনওই তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। বাবার সঙ্গে নিয়ম করে রেওয়াজের অভ্যাসও ছিল না। যদিও বাবা চেষ্টা করতেন।

স্বাগতালক্ষ্মী অবশ্য গান গাইতে ভালবাসতেন। রেডিও’র ‘অনুরোধের আসর’ থেকে বিদেশি গান— গোগ্রাসে গিলতেন। ফোটোকপি হতো মাথায়। তারপর সেই সমস্ত গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিতেন বন্ধুদের। প্রথাগত সংগীতশিক্ষা চিরকালই তিনি ফাঁকিতে কাটিয়ে দিয়েছেন।

কেউ মানেন, কেউ মানেন না। বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন— ময়রার ছেলে ময়রা হতে না-চাইলেও মিষ্টি বানানোর শৈল্পিক দক্ষতা তাঁর রক্তে থাকে। স্বাগতালক্ষ্মীর রক্তে গান বাসা বেঁধেছিল। যত বড় হচ্ছেন, নিচু স্কুল থেকে উঁচু স্কুল, সেখান থেকে কলেজ— স্বাগতালক্ষ্মী গান গাইছেন। যখনই গাইছেন, তারিফ মিলছে। মিলছে পুরস্কার। একটি জাতীয় ট্যালেন্ট-হান্ট প্রতিযোগিতায় গান গেয়ে সরাসরি মুম্বইয়ে প্লে-ব্যাকের সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন বেশ ছোট বয়সে। কিন্তু মুম্বই যেতে রাজি হননি। যিনি নিয়ে যাবেন বলেছিলেন, তাঁর কথাবার্তা পছন্দ হয়নি তাঁর। ‘কাস্টিং-কাউচ’ শব্দটা তখনও মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব পরিচিত শব্দ নয়।

এখানে বলে রাখা ভাল, ক্রিকেটের পাশাপাশি স্বাগতালক্ষ্মী টেবিল টেনিসও নিয়মিত খেলতেন। রীতিমতো তালিম নিয়ে। সুযোগ পেলে এখনও খেলেন। তাঁর নামে তৈরি গানের অ্যাকাডেমির উপর তলায় টেবিল টেনিস বোর্ড রাখা আছে। গান শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে সেখানে গিয়ে পিংপং বল পিটিয়ে আসেন।

মেয়ে যে গানে থাকবেন না, বুঝে গিয়েছিলেন বাবা। উচ্চমাধ্যমিকের পর চেয়েছিলেন স্বাগতালক্ষ্মী ইংরেজি সাহিত্য পড়ুন। হয়তো সে কারণেই বেপরোয়া মেয়ে বেছে নিয়েছিলেন বাণিজ্য। কমার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েট হয়ে দিল্লি গেলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পড়তে। থাকতেন কাকু-কাকিমার বাড়ি। নিঃসন্তান দম্পতি স্বাগতালক্ষ্মীকে মেয়ের মতোই দেখতেন। প্রতি রাতে আবদার করতেন রবীন্দ্রসংগীত শোনানোর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের পছন্দ ছিল ব্রহ্মসংগীত। একেক দিন ২০-২৫টা করে গানও গেয়েছেন স্বাগতালক্ষ্মী। ততদিনে তিনি বুঝতে পেরেছেন, এতদিন যেটায় বিশেষ গুরুত্ব দেননি, সেই গানেই আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের গানে।

গানে ফিরলেন ছাত্রী। দিল্লির পড়াশোনা বন্ধ করে কলকাতায় চলে এলেন। শুরু হল রবীন্দ্রভারতীর তালিম। রবীন্দ্রসংগীতের ক্লাসের ফাঁকে তখনও বন্ধুদের গুলাম আলির গজল অবশ্য শোনাচ্ছেন। শোনাচ্ছেন লোকগীতি। কখনও কখনও শিক্ষকেরাও শুনে ফেলছেন সেসব।

মায়া সেনকে গুরু মানলেন স্বাগতালক্ষ্মী। তৈরি হতে শুরু করল তাঁর নিজস্ব গায়কি।

‘‘রবীন্দ্রনাথের গান আমার ঈশ্বরচেতনাও বদলে দিয়েছিল। এখনও বদলাচ্ছে।’’ কপালে টিপের উপর সিঁদুরের টিপে হাত বোলালেন শিল্পী।

তাঁর পুজোর ঘর ভারী মজার। কালী থেকে কোরান— সবই আছে সেখানে। অধ্যাত্মবাদ তাঁর সদাসঙ্গী। যে কোনও বিষয়ে ‘ভাইব্রেশন’ তাঁর কাছে খুব জরুরি। ‘পজিটিভ ভাইব্রেশন’ না-পেলে তিনি কোনও কাজে হাত দেন না। সৌরজগৎ, মহাবিশ্ব নিয়ে তাঁর অপার কৌতূহল। ‘এনার্জি’ সম্বন্ধে আরও আরও জানতে চান তিনি। এসব ভাবতে ভাবতে, অধ্যাত্মবাদের বিভিন্ন পর্ব অতিক্রম করতে করতে আপাতত রবীন্দ্রনাথে এসে ঠেকেছেন। বলছেন, পৌত্তলিক আচার থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ক্রমশ নিয়ে যাচ্ছেন মনের মানুষের কাছে। নিরাকার ঈশ্বরের কাছে।

চিনি-দুধ ছাড়া চা প্রায় শরবত হয়ে যাওয়ার পর, তাতে চুমুক দিলেন স্বাগতালক্ষ্মী। হাত বাড়িয়ে নামিয়ে আনলেন ইংরেজিতে অনুবাদ করা তাঁর রবীন্দ্রনাথের গানের বই— ‘গ্যালাক্সি’। দেখালেন অ্যালবাম। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে গল্প লিখছেন শিল্পী। এমন আশ্চর্য প্রজেক্ট এর আগেও তিনি করেছেন। আস্ত ‘গীতবিতান’ মাত্র ৮৫ দিনে রেকর্ড করেছেন। আর্কাইভ করার জন্য। কাউকে শোনানোর জন্য নয়। অথচ এখনও সেটা ‘বেস্টসেলার’। সারাক্ষণ এমন নানান ভাবনা মাথায় ঘোরে তাঁর। কোনওটা হয়, কোনওটা হয় না।

শিল্পীর দাবি, যেমন বিয়েটা তাঁর হয়নি।

প্রেমেও পড়েননি কখনও?

স্বাগতালক্ষ্মী হাসছেন। বলছেন, প্রেমে পড়েছেন বহুবার। এখনও পড়েন। কিন্তু ব্যাটে-বলে হয়নি সব সময়।

মায়ের গান গাইতে না-পারার অভিমান কি তাঁকে গার্হস্থ জীবন থেকে দূরে ঠেলে রেখেছে?

হাসি চওড়া হল স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তের। উত্তর দিলেন না— ‘‘চলুন, গানের ঘরে যাই।’’

স্তূপীকৃত জিনিসে ঠাসা গানের ঘরে একদিকের দেওয়াল জুড়ে পুজোর ব্যবস্থা। অন্যদিকে কি-বোর্ড।

‘‘বসন্তের গান গাই?’’ তাঁর মায়ের পছন্দের গান। গানের শব্দ যেন তাঁরই উত্তর। প্রেমের বিভিন্ন শেড পেঁয়াজের খোসার মতো খুলছে।

গান থামল।

কর্ড থামল না।

‘জাম্প কাট’।

লেননের ‘ইমাজিন’এ লাফ দিলেন শিল্পী।

প্রেম সম্পূর্ণ হল।

8 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন