dreamliferupatolibarisal

কলাম

শিক্ষার অবক্ষয় বনাম শিক্ষকের নৈতিকতার বিপর্যয়

বরিশালটাইমস রিপোর্ট

বরিশালটাইমস রিপোর্ট

২৯ মে, ২০২৫ ১৬:১০

প্রিন্ট এন্ড সেভ

শিক্ষার অবক্ষয় বনাম শিক্ষকের নৈতিকতার বিপর্যয়

প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ➤ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ নানান সমস্যায় জর্জরিত। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা এবং স্বেচ্ছাচারিতা। পৃথিবীব্যাপি একটি স্বতঃসিদ্ধ উক্তি আছে- ‘প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচিত হয় সেটির শিক্ষক দ্বারা, শিক্ষকের কর্মদক্ষতা, সক্ষমতা, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা শিক্ষাকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে।’ অর্থাৎ শিক্ষকরাই হলো প্রতিষ্ঠানের মেইন ফ্যাক্টর বা প্রধান স্তম্ভ তথা মূল চালিকাশক্তি। আমরা যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি বা করেছি তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকেই আমার আজকের এই লেখার অবতারণা।

শুধু শিক্ষাই নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা নিরূপণ হয় শিক্ষা ও গবেষণার মানের উপর ভিত্তি করে- যা মূলত নির্ভর করে শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াসের উপরেই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই শিক্ষকরাই নানাভাবে নিগৃহীত ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের শোষণ ও অধিকার হরণের মূলে রয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারগণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরে তারা নিজের গদি সুরক্ষা ও কিছু ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য নিজের পক্ষে একটি তোষামোদি গ্রুপ সৃষ্টি করেন। নিজের অনুগত বাহিনী তৈরি করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিদ্যমান ঐক্যের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করেন। নানান লোভ-লালসা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের পক্ষে টেনে আস্থাভাজন শিক্ষকদের নিয়ে দলবাজি শুরু করেন।

ফলে অল্প কিছুদিনেই শিক্ষকদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটি বিভাজন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি ব্রিটিশদের সেই ‘Divide and Rule’ পলিসি অবলম্বন করে নিজের মনের মতো প্রশাসন পরিচালনার অপচেষ্টা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হয়ে থাকেন নিজের অনুগত সেই তোষামোদি গ্রুপের সহযোগিতায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল, ক্ষমতার দাপট ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই এসব করা হয়। এমন হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব এবং শিক্ষার পরিবেশ অবনমিত করা হয়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম পালনে একদল সবসময় সচেষ্ট থাকেন। তাদের কাছে শিক্ষা এবং গবেষণার মূল্য অতি নগণ্য। এদিকে অপর গ্রুপকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকতে হয়। ফলে তারাও শিক্ষা আর গবেষণায় মনোনিবেশ করার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হন।

দেশের শিক্ষাঙ্গনে এই অবক্ষয়ের চিত্র এখন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। কর্ণধারদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য আজ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও স্বচ্ছ নয়। কর্ণধার নিয়োগে প্রায়ই মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা, সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও ম্যানেজারিয়াল স্কিলনেস, এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না বললেই চলে। নিয়োগ প্রদানের ক্ষেত্রে তোষামোদি রাজনৈতিক বিবেচনা ও সংযোগ স্থাপনের দক্ষতা তথা লবিংয়ের উপরই বেশি নির্ভর করে। ফলে অনেক সময়ই প্রচলিত আইন ও বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হয় না এসব নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। ফলে এর সরাসরি কুপ্রভাব পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়।

অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, যার কথা কেউ কখনো চিন্তা করেনি কিংবা যার ওই চেয়ারে বসার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা নেই এমন কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়। লবিং আর তদবিরের জোরে বাগিয়ে নেওয়া হয় চেয়ার। ফলে তাঁর যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার অভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব নিয়মকানুন আর নীতি-নৈতিকতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের কর্ণধার নিয়োগে সঠিক কোনো নীতিমালা না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি, তোষামোদি কিংবা অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে কার্যসম্পাদন হয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেট ঘটনা।

এভাবে অনৈতিক পন্থায় যারা নিয়োগ লাভ করেন সঙ্গত কারণেই তাদের কোনো দায়বদ্ধতা কিংবা জবাবদিহিতা থাকে না। ফলে দায়িত্ব পেয়েই তিনি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। সর্বক্ষেত্রে স্বৈরাচারী আচরণ শুরু করেন। অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এসব কারণেই এখন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মিডিয়ার শিরোনাম হয়। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যায়ের কর্নধারদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ, ক্ষমতার চরম অপব্যবহার এবং চারিত্রিক ও নৈতিক স্খলনসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগের খবর হরহামেশাই শোনা যায়। এজন্য অনেককে চাকরিচ্যুত হয়ে এমনকি শ্রীঘরে পর্যন্ত যেতে হয়।

অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নানাবিধ বিভাজন সৃষ্টি করেন। এতে তিনি নিজে লাভবান হলেও শিক্ষার পরিবেশ ধ্বংস হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। অনেকে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে থেকে অনেকে মিথ্যার আশ্রয়, প্রতারণা, কথা দিয়ে কথা না রাখা, মোনাফেকি আর বিশ্বাসঘাতকতা করার মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ফলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যোগ্যতা হারান তিনি। এসব অযোগ্য ব্যক্তিরা নানান কূটকৌশলে কাঙ্ক্ষিত নিয়োগ বাগিয়ে নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গবেষণাকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে নিপতিত করেন।

আমার এক বন্ধু আক্ষেপ করে বলেন- ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগ দেওয়া হয় না, নিয়োগ নেয়া হয়।ছলেবলে, কৌশলে কিংবা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। ফলে এই নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি, দেশ ও জাতির প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। তাদের মাঝে থাকে না সততা, দেশপ্রেম, শুদ্ধাচার কিংবা নীতি-নৈতিকতার বালাই। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি- যিনি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হন মূলত তাঁর ইচ্ছার উপরেই সবকিছু নির্ভর করে। সর্বত্র কর্তার ইচ্ছায় কর্ম এবং কীর্তন হয়। এর ফলে মারাত্মক প্রভাব পড়ে শিক্ষা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে। এসব কারণেই আজ শিক্ষার বিপর্যয় ঘটেছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় দেখা দিয়েছে চরম অবক্ষয়। আমাদের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাব বর্তমানে সুস্পষ্টভাবে সর্বত্র দৃশ্যমান।

বিশ্বের বহুল প্রচলিত ও স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান পরিমাপক পদ্ধতি টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) কর্তৃক Ranking-2024’এ বিশ্বের ১০৮ টি দেশের ১,৯০৪ টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে বাংলাদেশের ২১ টি বিশ্ববিদ্যালয় ‌র‌্যাঙ্কিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০-এর মধ্যে স্থান পেয়েছে। এরমধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরের অবস্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরে পর্যায়ক্রমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-সাউথ, বাকৃবি, বুয়েট, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম।

তবে এবারই প্রথম দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পেছনে ফেলে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সামনে চলে এসেছে।
The Times Higher Education World University Ranking-2024 adopts methodology which includes 18 carefully calibrated performance indicators that measure an institution’s performance across five areas: teaching, research environment, research quality, industry, and International outlook.

যে পাঁচটি ইন্ডিকেটরস তথা সূচক দিয়ে শিক্ষার মানদণ্ড বিশ্লেষণ করা হয় সেগুলোর সব কয়টির সাথেই শিক্ষকগণ ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। সেই শিক্ষকদের নিয়ে যদি নানান বিরোধ ও গ্রুপিং সৃষ্টি করা হয় তাহলে সবকিছুই মুখ থুবড়ে পড়বে সন্দেহাতীতভাবে। তাছাড়া কেউ যদি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ভিশন নিয়ে কাজ না করে নিজের ব্যক্তিগত হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্য নিয়ে মহান শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন সেক্ষেত্রে যা হবার তা-ই হবে এবং বর্তমানে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সামগ্রিক বিষয়ে দক্ষতা, মেধা ও দৃষ্টিভঙ্গির উপরেই মূলত অনেক কিছু নির্ভর করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন যাদেরকে উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ দিলে তারা শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন।

সকল বিষয়ে মেধা সৃষ্টি করার পরিবেশ সংরক্ষণ করার প্রাথমিক দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। যে কথা দিয়ে আমার লেখাটা শুরু করেছিলাম তা ছিল সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কম্পোনেন্ট হলেন শিক্ষক। আর সেই শিক্ষকদের সঠিকভাবে ব্যবহার ও পরিচালনার দায়িত্ব হলো প্রতিষ্ঠান প্রধানের। তাই সততা, নিষ্ঠা ও নীতি-নৈতিকতার সাথেসাথে সব ধরনের লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। এটা না পারলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত হবে।

দেশে শিক্ষার্থীর মধ্যে যদি মেধা সৃষ্টি করা না যায়, সততা ও দেশপ্রেম তৈরি করা না যায় তাহলে আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের কথা বলছি তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। শুধু মেধা থাকাই যথেষ্ট নয়। যে মেধার মধ্যে সততা এবং শুদ্ধাচার না থাকে সেই মেধা মূল্যহীন। পক্ষান্তরে এমন মেধা দেশ ও জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। এছাড়া সামনে আসছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial Intelligence) যুগ; যা সম্পূর্ণভাবে নতুন ধারণার উপর ভর করে সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করবে। আমাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এই যুগে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগীকরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ এবং শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতার বিপর্যয় রোধ করতে না পারলে অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। #

লেখকঃ প্রফেসর ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন
প্রাক্তন উপাচার্য,
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম নেতা।

বিবিরতালাবের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে মহান উদ্যোগ

বরিশালটাইমস রিপোর্ট

বরিশালটাইমস রিপোর্ট

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১৮:৩১

প্রিন্ট এন্ড সেভ

বিবিরতালাবের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে মহান উদ্যোগ

হেনরী স্বপন>> জাতিধর্ম নির্বিশেষে ব্যবহৃত উন্মুক্ত পানীয় জলের চাহিদা মেটানোর জন্য বিবিরতালাব (তালাব: ফার্সি শব্দ- জলাশয়) খনন করা হয়েছিল। কালক্রমে এটি এখন বিবিরপুকুর হয়ে বরিশালবাসীর আত্মার অংশ হয়ে উঠেছে। বরিশালবাসীর সুপেয় জলের অভাব মোচনের জন্য জনদরদী জিন্নাত বিবি আঠারোশতকে এই পুকুরটি খনন করেছিলেন, বলে জানা যায়। এই পুকুরের চারপাশে ৪টি ঘাটলা ছিল। তখন সেই ঘাট থেকে বরিশালের সকল ধর্মের সব মানুষ খাবার পানি সসরবরাহ করতেন। কেউ স্নান করত না এবং ধোয়াকাচার কাজও হত না। সে সময় এই নিয়গুলো কঠোরভাবে পালিত হতো। যেহেতু তৎকালীন সময় রাখালবাবুর পুকুর থেকে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা খাবার জল সসরবরাহ কতে পারতেন। কিন্তু বিবিরতালাব থেকে সকল সম্প্রদায়ের সব মানুষ এই পুকুরের পানি খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করতে পারত। তাই, এই পুকুরটিকে অসামপ্রদায়িক চেতনার উল্লেগযোগ্য নিদর্শনও বলা যায়।

এই জলাশয় খনন করে জেন্নাত বিবি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে এমোন একটি ট্রাস্টি দলিলও করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন যে, “পুকুরটি কেনোদিন ভরাট করা যাবে না, এর চাপাশের ঘাটলায় গোসল, সাবান সোডার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। জলাশয়ের পানি পরিস্কার রাখতে হবে এবং পাড়ঘেঁষে কোনও ইমারত, দেয়াল, তোরণ নির্মাণ করে পুকুরের সৌন্দর্য ক্ষুন্ন হয়, এমনও কিছুই করা যাবে না।”

যেহেতু, ১৯০০-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ভূমি জরিপে জিন্নাত ও কেরি’র নামোল্লেখ আছে। সরকারের জাজেস সেরেস্তায় খুঁজলে এই চুক্তির দলিলও পাওয়া যাবে, হয়তো। অথচ, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় মহল্লাবাসী ও অগণিত ফাস্টফুড ব্যবসায়ী কেউ চুক্তির কিছুই মানছে না। বরং এরাই দিনের পর দিন ঐতিহ্যবাহী এই পুকুরের সৌন্দর্যকে গলাটিপে হত্যা করছে। কেননা, সিটি কর্পোরেশনের কর্তারা অর্থের বিনিময়ে মোবাইল কোম্পানির স্থায়ী বিলবোর্ড স্থাপনরে মাধ্যমে পুকুরটির যতোটা শোভা বিনষ্ট করেছনে। ততধিক উচ্ছিষ্ট খাবারের বর্জ্য ফেলে এটিকে দুর্গন্ধময় জলাশয়ে পরিণত করছে, তেমনি এর চারপাশে যত্রতত্র বিলবোর্ড, দলীয় পোস্টার ফেস্টুনে কতিপয় রানৈতিক নেতাদের ছবিতে ছবিতে সয়লাব করে, পুকুরটির স্বাভাবিক অঙ্গছেদন এবং শোভা বিনষ্ট করছেন।

সম্প্রতি বর্তমানে বরিশাল সিটি করপোরেশন নগর ভবনের আধিপতি মো. রায়হান কাওছার সাহেব এককালে যে বিবিরতালাবের সুপেয় জলে আমাদের জীবনের তৃষ্ণা মিটেছে, সেই পুকুরের জলে ঝলমলে সূর্যের আলোর রোশনাই ফেরাতে এর চারপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজনৈতিক দখলদারদের আমলা নির্ভরতা ও দলীয় হামটি-ডামটির তোয়াক্কা না করে, বরিশালবাসীর প্রাণভোমরা পুকুরটির সেই তিলত্তোমা রূপÑ স্বঅবয়বে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনতে তিনি যে, ঈর্ষণীয় এবং অনন্য ন্যায়পালের উদ্যোগের মতোই মহান কাজ করে চলেছেন এজন্য সিটিবাসী আপনাকে মনেও রাখবে বহুকাল।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, বরিশাল।

"বরিশালে বিমানের দাফন!"

আরিফ আহমেদ মুন্না

আরিফ আহমেদ মুন্না

২৬ জুলাই, ২০২৫ ১৩:০৪

প্রিন্ট এন্ড সেভ

"বরিশালে বিমানের দাফন!"

ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা রুটে বাংলাদেশ বিমানের সর্বশেষ ফ্লাইটটিও আজ বন্ধ হয়ে গেলো। এর আগে বন্ধ হয়েছিল ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এবং নভো এয়ারের বিমান। আমার কাছে এই ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পরেই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলাম- 'বরিশাল রুটে বিমানে যাত্রী কমতে কমতে একদিন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে।' বাবুগঞ্জের একজন গুণীজন অবশ্য আমার সাথে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন- 'বিমানের যাত্রীরা বাসে চড়বে না। তাই লঞ্চের যাত্রী কমলেও বিমানের যাত্রী কমবে না। বিমান কখনোই বন্ধ হবে না।' ২০২২ সালে পদ্মাসেতু চালুর সময় ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা রুটে সরকারি বাংলাদেশ বিমান এবং বেসরকারি ইউএস-বাংলা ও নভো এয়ারের তিনটি ফ্লাইট নিয়মিত চলাচল করতো। এরমধ্যে ইউএস-বাংলা প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে ডবল ট্রিপ দিতো। তবুও আগাম বুকিং করে না রাখলে টিকেট পাওয়া যেতো না। তখন সেই অবস্থা দেখেই হয়তো তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিন্তু আজ ৩ বছরের মাথায় যাত্রী সংকটে একে একে ৩টি এয়ারলাইন্সের বিমানই বন্ধ হয়ে গেছে।

বিমানের পাশাপাশি পদ্মাসেতুর বিরাট প্রভাব পড়েছে বরিশালের নৌপথেও। ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা নৌপথে প্রতিদিন চলাচলকারী বিলাসবহুল ৯-১০টা লঞ্চ থেকে যাত্রী কমতে কমতে এখন মাত্র ২টা লঞ্চে নেমেছে। রোটেশন পদ্ধতিতে প্রতিদিন ২টি লঞ্চ চললেও তাতে বিশেষ উপলক্ষ্য ছাড়া আশানুরূপ যাত্রী নেই। এই বাস্তবতা অনুধাবন করেই আমি সেদিন চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলাম- 'পদ্মাসেতু চালুর পরে বরিশালে যদি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক কলকারখানা গড়ে না ওঠে তাহলে লঞ্চশিল্প হুমকির মুখে পড়বে এবং বরিশালে বিমান টিকবেই না।' শুধু পর্যটন কুয়াকাটাকে বেইজ করে ঢাকা-কুয়াকাটার মধ্যবর্তী জায়গা বরিশালে একটি বিমানবন্দর টিকে থাকার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এই বিমানবন্দরের অবস্থান যদি পটুয়াখালী জেলার যেকোনো সুবিধাজনক স্থানে হতো তাহলে এটা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এবং পায়রা বন্দরের কল্যাণে মাথা উঁচু করেই টিকে থাকতো। বরিশালে ইকোনমি জোন অর্থাৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি না হলে বরিশালে বিমান টিকবে না এটা বুঝতে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।

বরিশাল বিভাগীয় শহর হলেও এখানে কোনো বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা কিংবা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা না থাকায় এই অঞ্চলে ভিআইপি-সিআইপিদের যাতায়াত নেই বললেই চলে। তাহলে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বিমানে চড়বে কারা? বিমানে সাধারণ যাত্রী উঠবে কেন? শখ পূরণ করতে ৪-৫ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে কয়দিন সাধারণ মানুষ বিমানে চড়তে পারে? তাছাড়া কুয়াকাটার পর্যটকরা বিমানে উঠলে তাদের মিরপুর কিংবা মতিঝিল থেকে ঢাকার উত্তরা বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা। আবার বরিশাল বিমানবন্দরে নেমে কুয়াকাটা যেতেও লাগে প্রায় আড়াই থেকে ৩ ঘন্টার বেশি। তাহলে পর্যটকরা তাদের কুয়াকাটা ভ্রমনের জন্য বিমানের অর্ধেক পথকে কেন বেছে নেবেন? পদ্মাসেতু চালুর পরে বরিশাল থেকে সড়কপথে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান বা মতিঝিল যেতে সময় লাগে সাড়ে ৩ ঘন্টা। এদিকে ঢাকার উত্তরায় বিমানবন্দরে নেমে যানজটের কারণে গুলিস্তান কিংবা মতিঝিল আসতে পিক আওয়ারে কখনো কখনো সময় লাগে ৩ ঘন্টার বেশি। বিমানে আকাশপথে বরিশাল থেকে ঢাকা যেতে মাত্র ২০ মিনিট সময় লাগলেও ঢাকার উত্তরা বিমানবন্দরে নেমে মতিঝিল, গুলিস্তান বা মিরপুরের গন্তব্যে যেতে সময় লাগে কমপক্ষে ২ থেকে কখনো ৩ ঘন্টার বেশি। একই সময়ে বরং সড়কপথে পদ্মাসেতুর উপর দিয়ে বরিশাল চলে আসা সহজ। তাহলে কোন সুবিধার জন্য যাত্রীরা বিমানকে বেছে নেবেন?

বিমানের নিয়মিত যাত্রীরা এখন পদ্মাসেতু পাড়ি দিয়েই নিজের প্রাইভেট কার নিয়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘন্টায় বরিশাল চলে আসেন। যারা নিজের গাড়ি বরিশাল আনেন না তারা আসেন বিলাসবহুল সোহাগ পরিবহনের অত্যাধুনিক স্ক্যানিয়া বাস কিংবা গ্রীণলাইনের ভলভো গাড়িতে। অভ্যন্তরীণ ঢাকা-বরিশাল-ঢাকা রুটে চলাচলকারী ৬৭-৭০ আসনের বিমানগুলোর সিটের চেয়ে এসব গাড়ির সিট অনেক বেশি উন্নত, বিলাসবহুল এবং আরামদায়ক। ৪৫০০ টাকার একই সেবা ও সুবিধা যদি ১২০০ বা ১৫০০ টাকায় পাওয়া যায় তাহলে সময় এবং টাকার শ্রাদ্ধ করে মানুষ কেন বিমানে উঠবে? সঙ্গত কারণেই এখন ভ্রমনে আসা পর্যটকরা ঢাকা-কুয়াকাটা রুটের বিলাসবহুল ডাইরেক্ট বাসে কুয়াকাটা ভ্রমন করেন। বিমানবন্দর পটুয়াখালী কিংবা বরগুনা জেলার সুবিধাজনক স্থানে না নিলে বরিশাল বিভাগে আপাতত যাত্রীবাহী বিমানের স্থায়ী মৃত্যু সুনিশ্চিত। এটাই ভৌগোলিক এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা। ভবিষ্যতে বরিশাল কেন্দ্রিক বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা গড়ে না উঠলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। পিছিয়ে পড়বে প্রাচ্যের ভেনিস খ্যাত প্রাচীন সভ্যতার ঐতিহাসিক নগরী এই বরিশাল। বরিশালের আকাশে আর কখনোই উড়বে না যাত্রীবাহী বিমান। ভোলার গ্যাস বরিশালে এনে একটি শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে এবং বরিশালের ছোট পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে একটি পর্যটন জোন তৈরি করতে না পারলে বরিশালের আকাশপথে স্বপ্নের বিমান চিরতরে দাফন হয়ে যাবে। পরবর্তীতে কুয়াকাটা পর্যন্ত ৬ লেনের মহাসড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হলে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী লঞ্চের কুলখানিও সম্পন্ন হবে বলে আমার ধারণা। #

❑ লেখাঃ আরিফ আহমেদ মুন্না

সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও মানবাধিকারকর্মী।

বাবুগঞ্জঃ ২৬ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ।

কর্নেল-খোকনের ‘নতুন বরিশাল’ হোক, রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত!, এটাই শহরবাসীর প্রত্যাশা

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল

২৯ মে, ২০২৫ ১৬:১৬

প্রিন্ট এন্ড সেভ

কর্নেল-খোকনের ‘নতুন বরিশাল’ হোক, রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত!, এটাই শহরবাসীর প্রত্যাশা

রাজনীতির মাঠে উভয়েই ক্লিন ইমেজের এবং সৎ-স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হিসেবে সমাধিক পরিচিত। বিপরিতে উভয়ে বরিশালের স্থানীয় রাজনীতিতে স্বল্পসময়ে পেয়েছেন বেশ জনপ্রিয়তা, প্রসংশিত হয়েছেন, হচ্ছেন আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডে। ক্ষমতাসীন আ’লীগ ঘরনার রাজনৈতিক এবং জনপ্রতিনিধি হলেও উন্নয়ন কর্মকান্ডের বদৌলতে তাদের এই দলের বাইরেও রয়েছে সুনাম। এতক্ষণ যাদের কথা বলছিলাম, তাদের একজন বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) জাহিদ ফারুক শামীম, অপরজন বরিশাল সিটির নবনির্বাচিত মেয়র আবুল খায়ের ওরফে খোকন সেরনিয়বাত। নয়া এই মেয়র এখন পর্যন্ত বিসিসির দায়িত্বভার গ্রহণ না করলেও তার ওপর বরিশালবাসী যে আস্থা রেখেছে, তার প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। ১২ জুন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পঞ্চম মেয়াদের নির্বাচনে তাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছে জনগণ।

খোকন সেরনিয়াবাতকে ভোটে নির্বাচিত করতে নেপথ্য কারিগর যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন বরিশাল সদর আসনের এমপি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনসহ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ আসনে জনপ্রতিনিধি তিনি। খোকন সেরনিয়াবাতকে নিয়ে ভোটের মাঠে নামার আগে এবং জয়লাভের পর উভয় জনপ্রতিনিধির সম্পর্কের কোনো ঘাটতি নেই। বরং তারা অভিন্ন মেরুতেই অবস্থান করছেন। তারা দুজনেই নির্বাচন পূর্বাপর স্থানীয় বাসিন্দাদের বারংবার অঙ্গীকার করে আসছেন, বরিশাল হবে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, মাদকসহ ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত একটি শহর’। তাদের এই প্রতিশ্রুতির প্রতি বরিশাল শহরবাসীর যে আস্থা আছে, তার প্রমাণ ১২ জুনে ভোটে পেয়েছেন। এবং বিপরিতে কর্নেল-খোকন তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় অভীষ্ট লক্ষে এগিয়ে চলছেন, কী ভাবে সন্ত্রাসমুক্ত বরিশাল নগরী গড়ে তোলা যায়।

যদিও ইতিমধ্যে উভয় জনপ্রতিনিধিই ঘোষণা দিয়েছেন এবং নয়া মেয়র খোকন সেরনিয়াবাতের নির্বাচনী ইশতেহারেও প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি ‘নতুন বরিশাল’ গড়বেন। জনপ্রতিনিধির ওই আশ্বাস শহরবাসীর মনে আস্থা জুগিয়েছে, বেড়েছে নাগরিক প্রত্যাশাও।

কারণ এমপি জাহিদ ফারুক শামীম তাঁর আওতাধীন এলাকাসমূহ অর্থাৎ সদর উপজেলার ভাঙনরোধসহ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে যথেষ্ট ভুমিকা রাখলেও প্রভাবশালী একটি মহলের বাধায় বরিশাল নগর উন্নয়নে ইচ্ছা এবং সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজ করতে পারেননি। এনিয়ে প্রতিমন্ত্রীকে আলোচনার প্রাক্কালে ক্ষেত্র বিশেষ আফসোস করতেও শোনা যায়। বছর দুয়েক পূর্বে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শহর অভ্যন্তরের ফুসফুস খ্যাত ৬টি খাল সংরক্ষণ করাসহ পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নিলে সিটি কর্পোরেশনের বাধায় তা আটকে যায়।

অথচ শহরবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা অন্তত শহর অভ্যন্তরের খালগুলো সংরক্ষণ করে যেনো নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করা হয়। এনিয়ে সাবেক সফল সিটি মেয়র শওকত হোসেনের বেশ উদ্যোগও ছিল, কিন্তু তার মৃত্যুর পর বরিশাল সিটির তৃতীয় পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি নেতা আহসান হাবিব কামাল মেয়র নির্বাচিত হলে, তিনিও খাল উদ্ধারে তেমন কোনো ভুমিকা রাখেননি। এরপর চতুর্থ পরিষদ নির্বাচনে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মেয়র নির্বাচিত হলে তিনিও খালগুলো উদ্ধারে ভূমিকা রাখেননি, বা রাখতে পারেননি। যদিও সিটি কর্পোরেশনের তরফে মাসছয়েক আগেও বলা হচ্ছিল, শহর অভ্যন্তরের খালগুলো উদ্ধারে প্রকল্প চলমান আছে, কিন্তু এই বলাবলির মধ্যে মেয়র সাদিকে মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে। আর মাত্র তিন মাস পরেই তাঁর আপন চাচা খায়ের আব্দুল্লাহ সিটির মসনদে বসবেন।

নাগরিক সমাজের ভাষ্য হচ্ছে, যেহেতু এমপি জাহিদ ফারুক শামীম বরিশাল শহর উন্নয়ন প্রশ্নে আন্তরিক আছেন এবং নতুন মেয়র খোকন সেরনিয়বাতেরও অঙ্গীকার আছে, সেক্ষেত্রে আগামীতে উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় জলাবদ্ধতা দূরিকরণে সমাধান আসছে এটা বলার অপেক্ষা নেই। সৎ-স্বচ্ছ এবং ক্লিন ইমেজের এই দুই জনপ্রতিনিধি আগামীতে যে ‘নতুন বরিশাল’ গড়ার অঙ্গীকার করছেন, তাও বাস্তবায়নের কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু এখন নগরবাসীর মধ্যে যে প্রশ্ন বেশি ভার সেটি হচ্ছে, জনপ্রতিনিধিদ্বয় টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, মাদক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত ‘নতুন বরিশাল’ গড়তে কতটা সফল হবেন? এবং বরিশালে বর্তমানে রাজনৈতিক পরিচয়ে দখল-পাল্টা দখলের যে উৎসব চলছে! তা নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করছেন, না কী করবেন।

বলা বাহুল্য যে, বিগত সময়ে বরিশাল শহর উন্নয়ন অপেক্ষা সন্ত্রাসীদের উৎপাত বেশি লক্ষ্যণীয় ছিল। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে একটি অংশ নিজের আখের গুছিয়েছে, দেখিয়েছে ত্রাস, ক্যাডাভিত্তিক সন্ত্রাসের ভয়ে বলতে গেলো তটস্থ ছিল বরিশালবাসী। ভয়ে মুখ না খুললেন, আশায় ছিল পরিবর্তনের। আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ বরিশাল সিটিতে আ’লীগ মনোনীত প্রার্থী হয়ে আসলে নগরবাসী সুবর্ন সুযোগটি লুফে নেয়, ভোট দিয়ে তাকে নগরপিতার আসনে বসিয়েছেন। কিন্তু শহরবাসীর অতীত রাজনৈতিক সন্ত্রাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, যা কিছুটা হলেও ভুলতে চান প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের দৌত নগর উন্নয়নে।

অভিজ্ঞমহলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হচ্ছে, অতীত থেকে শিক্ষা নিতে হবে ‘ক্যাডারভিত্তিক’ রাজনীতি করে কোনো জনপ্রতিনিধি তাদের চেয়ার বেশিদিন ধরে রাখতে পারেননি, যার প্রমাণ ইতিমধ্যে বরিশালের মানুষ পেয়েছেন। কিন্তু এরপরেও সুযোগ-সন্ধানী একটি অংশ থাকে তারা সার্বক্ষণিক নিজেস্ব স্বার্থ সংরক্ষণের ধান্দায় ব্যস্ত, এরাই মূলত সমাজ এবং রাজনীতির বিষফোঁড়া। তাদের অবস্থান বিগত সময়েও বিদ্যমান ছিল, এখনও আছে। যার দরুণ অনেকে ক্লিন ইমেজের জনপ্রতিনিধি জাহিদ ফারুক এবং খোকন সেরনিয়াবাতের দিতে আঙ্গুল তুলতে সাহস দেখাবেন। আবার দলীয় ঘরানার বিরোধীরা পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখছেন এবং হাসছেন, কেউ কেউ দিচ্ছেন উস্কানিও।

রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অভিমত হচ্ছে, স্বচ্ছ-সৎ মানসিকতার জনপ্রতিনিধি জাহিদ ফারুক এবং খোকনকে বিতর্কিত করতে দলীয় ঘরানার একটি অংশ মরিয়া হয়ে আছে। তারা সর্বদা চাইছেন কোনো কোনো ইস্যু তৈরি করে এই দুজনকে কী ভাবে ঝামেলায় মধ্যে ফেলা যায়। এসব বিষয় নিয়ে বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে চর্চা শোনা যাচ্ছে। ফলে উভয় রাজনৈতিকের লক্ষ্য-উদ্দেশ হবে নিজেদের সতর্কতার সাথে পথা চলা এবং কর্মী-সমর্থকদের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখা। কারণ তারা প্রতিমন্ত্রী ও নয়া মেয়রের ইমেজ যে কোনো সময় ম্লান করে দিতে পারে বিতর্কিত কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে। এক্ষেত্রে তাদের ওপর বিশেষ খেয়াল দিতে হবে, যারা দল বদল করে বিএনপি-জামায়াত থেকে এসেছে।

মহলটি বলছেন, সিটি নির্বাচনের মাসখানেক আগে থেকে বর্তমান সিটি মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ অনেকটা অন্তর্ধানে চলে যাওয়ার পরে বরিশালে ক্ষমতাসী দলের নেতাকর্মীদের সৃষ্ট বেশ কয়েকটি ঘটনা বিশেষ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-ঘাট-বাজার দখল, চাঁদাবাজি এবং মারামারিতে রক্তপাত নেতিবাচক রাজনীতি জানান দিচ্ছে, যা এমপি বা নতুন মেয়র কেউ সমর্থন করেন না। কিন্তু তারপরেও একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলছে, অনুঘটকরা জনপ্রতিনিধিদের নাম সামনে রেখে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করায় ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় নিতেও সাহস পাচ্ছেন না। আবার জনপ্রতিনিধিরাই মিডিয়ার সামনে আনুষ্ঠানিক বলছেন, দখলবাজ বা সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, বরিশালে গত দুই মাসে যে দখল পাল্টা দখলের খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তা কী ভিত্তিহীন বা অবান্তর? আবার যারা এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ড যারা করছেন তারা কী আইনে উর্ধ্বে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করছে না (!)

এক্ষেত্রে সুশীলমহলে অভিমত হচ্ছে, কর্নেল এবং খোকন সেরনিয়াবাতকেই এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস রুখে দিতে হবে এবং তাদের দুজনের সদিচ্ছাও আছে, তারা পারবেনও। তবে এটা সময়ের ব্যাপার, কারণ বরিশাল সিটির মেয়র এখনও মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ। বরিশাল সিটির মসনদে বসতে খোকন সেরনিয়াবাতের অপেক্ষা করতে হচ্ছে তিন মাসের অধিক সময়। হয়তো তিনি দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই রাজনৈতিক সন্ত্রাস দমনে যে অঙ্গীকার করেছেন, তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন।

সিটির নাগরিকেরা বলছেন, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে জাহিদ ফারুক শামীম একই সাথে সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে প্রতিশ্রুতির কিছুটা হলেও বরিশালবাসীকে দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি (বরিশাল ৫ আসন) সদর আসনের আওতাধীন বরিশাল উপজেলার রাস্তা-ঘাট উন্নয়নের পাশাপাশি নদী ভাঙন রক্ষায় যে অগ্রণী ভুমিকা রেখেছেন, তা সর্বমহলে আলোচিত এবং আলোড়িত। ফলে তার কাছে জনগণের আশা-আকাঙ্খা আরও বেড়েছে। পাশাপাশি বিপুল ভোটে জয়ী খোকন সেরনিয়াবাতের কাছেও তার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাইছেন জনতা।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের এই সদিচ্ছায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস বড় বাধা হতে পারে কী না, যেমনটি হয়েছে সাবেক সফল মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পরে। সর্বশেষ কাশিপুরে গত দুদিন পূর্বে দুই জনপ্রতিনিধির অনুগত ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে যে সংঘাত-রক্তপাত হলো তা রাজনীতির ইতিবাচক ধারা বলে মনে হচ্ছে না, মন্তব্য পাওয়া গেছে।

বিভিন্ন মাধ্যম জানা গেছে, কাশিপুরে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রতিমন্ত্রী-মেয়র উভয়েই হার্ডলাইনে আছেন। এ ধরনের ঘটনা আগামীতে কোনো প্রকার প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী-মেয়র। এমনকি কাশিপুরের ওই ঘটনা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করতে তারা দুজনেই পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।

ফলে ধারনা বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের ‘নতুন বরিশাল’ গড়ার ক্ষেত্রে যারা বড় বাধা হয়ে উঠবে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার! আর যারা দখল পাল্টা দখল এবং চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে ধাবিত হয়ে রাজনৈতিক ব্যানারে সন্ত্রাস করার কথা ভাবছেন, তাদের অবস্থা আরও করুন হতে পারে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ‘মানবতার মা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনাও অনুরুপ। সেক্ষেত্রে কর্নেল-খোকনের আগামীর ‘নতুন বরিশাল’ যে শান্তিময় হবে তা আর অস্বীকার করার সুযোগ থাকছে না।

হাসিবুল ইসলাম, কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক এবং সভাপতি, ‘নিউজ এডিটরস্ কাউন্সিল, বরিশাল’।

custom sidebar ads

Google AdSense
This is a demo ad. Your live ads will be displayed here once AdSense is properly configured.

জনপ্রিয়

Google AdSense
This is a demo ad. Your live ads will be displayed here once AdSense is properly configured.